|
|
|
|
|
|
|
ল্যাজে পা |
বরুণ চট্টোপাধ্যায় |
কে বলল আমাদের দেশে চিয়ারলিডার ছিল না, আইপিএল-এর হাত ধরে সে সদ্য জেঁকে বসল সংস্কৃতিভর্তি পবিত্র ভূখণ্ডে? ২ ডিসেম্বর, ১৮৮৪। সস্ত্রীক লর্ড রিপন আসছেন কলকাতায়। শিয়ালদহ ইস্টিশনে মহা উদ্দীপনা। নাট্যকার মনমোহন বসু গান বেঁধেছেন, ‘স্বদেশে যা’চ্ছো এখন্, ওহে রিপণ! ভারত্ ভুবন্ শূণ্য ক’রে/ দুঃখীদের রেখো স্মরণ্, এই নিবেদন্, কোটী নয়ন্ দেখ ঝুরে!... আশীর্ব্বাদ করি সবে, সুখে রবে, যশে ধরা যাবে পূরে/যারা সব্ ঘোর বিপক্ষ, ষণ্ডামার্ক, রিষের বিষে ম’র্ব্বে জ’রে!’ এই গানের সঙ্গে স্টেশনে হাজির ছিলেন আশি জন বাউল! এই বাজারেও আশি জন বাউল নামালে পেজ থ্রি মাত হয়ে যাবে! সমারোহটা যে মেগা হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর সেই কাণ্ড ঘটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বাউলদের যে চিয়ারলিডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহ আছে কি? হ্যাঁ, আপনার মনটা খুঁতখুঁত করছে, কারণ আশি জন মেয়ে থাকলে ঠিকঠাক চিয়ারগার্ল-এর ছবির সঙ্গে একেবারে নিখুঁত মিলে যেতে পারত। তা, আশি না হলেও, চল্লিশটি এমন মেয়ের জোগাড় দেখাতে পারি। হ্যাঁ, ওই স্টেশনেই, ওই সংবর্ধনাতেই।
ইস্টিশনে লাটসাহেব-লাটগিন্নি দেখার ভিড়ে কলকাতার বাছা-বাছা এলিটরা ছিলেন, তাঁদের পরিবারের অন্তঃপুরের মেয়ে-বউদেরও শামিল করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী তখনই নামজাদা লেখক ও সম্পাদক। তাঁর স্বামীও কম হোমরাচোমরা ছিলেন না। মেয়ে সরলা বেথুন স্কুলের উজ্জ্বল ছাত্রী। সেই সরলাও ইস্টিশনে ছিলেন লাটসাহেবের ট্রেনের অপেক্ষায়, কিন্তু তাঁর ভূমিকাটি শুধু উৎসুক দর্শনার্থীর নয়। স্মৃতিকথায় সরলা জানাচ্ছেন, ‘লর্ড রিপনের বিরাট অভ্যর্থনায় স্টেশনে সারবন্দী Flower Girls-দের মধ্যে আমায় একজন মনোনীত করা হল। অভ্যর্থনা কমিটির দেওয়া একই রকমের শাড়িজামা পরে, হাতে ফুলের সাজি নিয়ে প্রায় ত্রিশচল্লিশটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম ট্রেন আসার প্রতীক্ষায়। যেমন গাড়ি এসে থামল, লর্ড রিপন নামলেন, তাঁর উপর পুষ্পবৃষ্টি করলে ‘ফুলকুমারী’রা।’ |
|
রেগে গেলেন না কি? আরে কী মুশকিল, চিয়ারগার্ল বলতে যে ছোট জামাকাপড় পরতে হবে, তার কী মানে? যে হইহই করা লোকগুলোকে বা মেয়েগুলিকে একটা সমারোহে গায়ের জোরে স্রেফ শোভা বাড়ানোর জন্য নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, আসলে যাদের ভূমিকা কিছুমাত্র নেই, তারাই তো চিয়ারগার্ল। বা চিয়ারলিডার। অবান্তর ঝলমলে মানুষ। এই যেমন আমার এক বন্ধু (বাংলা দৃশ্যশ্রাব্য সংবাদ দুনিয়ার এক খলিফা সাংবাদিক) একটা অদ্ভুত খবর দিলেন সে দিন। চ্যানেলে চ্যানেলে ‘প্যানেল ডিসকাশন’-এ রাজনীতি অর্থনীতি নাট্যনীতির রথী-মহারথীদের মধ্যে কখনও কখনও এমন এক জন থাকেন, যাঁকে ওই দুনিয়ার ভাষায় ‘ফুলদানি’ বলা হয়। তিনি মতামতে বা তক্কাতক্কিতে তেমন মাতেন না, স্মিত মুখে মৌনী হাসিটি ঝুলিয়ে চমৎকার ছবি হয়ে থাকেন। তাতেও নাকি টিআরপি-র কাঁটা নড়ে। তা, এই মানুষটিকে, তা তিনি ছেলেই হোন বা মেয়েই হোন, যদি চিয়ারগার্ল বলা হয়, কু-প্রযুক্ত বিশেষণ হবে? মোদ্দা কথাটা বেশ ভাল করে বোঝা যাবে না?
ক্রিকেটে কমেন্ট্রি বক্সে যখন আমরা মন্দিরা বেদীর দেখা পাই আর কখনওই ঝুলন গোস্বামীর পাই না, তখন কি আমাদের বুঝতে বাকি থাকে চিয়ারগার্ল সব সময় সাইডলাইনের ধারে থাকেন না? মন্দিরাকে তো আনা হয়েছিল ২০০৩-এর বিশ্বকাপে, আইপিএল জন্মাতে তখনও পাঁচ বছর দেরি। আরও আগে, সম্ভবত আশির দশকে, বিশেষ করে শারজায় খেলা থাকলে, হেনরি নামে এক ধারাভাষ্যকারের উদয় হত, যিনি ব্যাটিং-বোলিং-এর চেয়ে বেশি উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন নারীর রূপের প্রসঙ্গে। ক্যামেরা গ্যালারিতে সুন্দরী ফ্যানেদের বিশেষ মুহূর্ত আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াত, আর যেই না দুরন্ত খুবসুরত কাউকে পরদায় দেখানো হত পিচে হয়তো তখন মিয়াঁদাদ ও কপিল প্রাণপণ তাল ঠুকছেন হেনরি হঠাৎ সব ছেড়ে নারীটির কেশ ও বেশ নিয়ে জুতসই দু’চার কথা বলে দিতেন। তাঁর এই প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বদভ্যাসে, ওই রূপবতী দর্শকটিই অনবধানে হয়ে উঠতেন চিয়ারগার্ল! এখন কত দর্শক উদ্ভট মুখোশ পরে বা কিম্ভূত ইয়া-চশমা লাগিয়ে খেলা দেখতে যান, যদি ক্যামেরা একটি বার তাঁর দিকে তাক করে। কেউ খালি গায়ে রং মেখে তার ওপর তেন্ডুলকর লিখে পতাকা নাড়ান। কেউ বেশ বিখ্যাত শিল্পী, বাউন্ডারি হলেই দড়াম দড়াম ড্রাম বাজান। এঁরা সব্বাই চিয়ারলিডার। না থাকলেই হত, কিন্তু থেকে একটু মস্তি বাড়াচ্ছেন।
যেমন আগেকার বাংলা নাটকের সখীর দল। নাটকটাকে তারা যে খুব এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, কিন্তু বেশ সবাই মিলে নেচেগেয়ে একটু আসর মাতাচ্ছে। নাটকটা বাড়তি জমে উঠছে। বহু নাটকে গল্পে গুলি মেরে নিয়মমাফিক সখীর দল ঢুকিয়ে দেওয়া হত। আবার যেখানে সখীর দল খুব জরুরি, সেখানে কখনও ততটা জরুরি নয় এমন তাকধাঁধানো সজ্জার আয়োজন হত। মানে, ‘মোরা জলে স্থলে কত ছলে মায়াজাল গাঁথি’ গানটির কথা বলছি। ‘মায়ার খেলা’র গান। মায়াকুমারীদের সমবেত সংগীত। মায়া জোরালো করতে, মায়াকুমারীদের মাথায় বিজলি বাতি লাগানো হয়েছিল অলক্ষ্য বৈদ্যুতিক তার ছড়িয়ে। আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর সখীসমিতির টাকা তোলার জন্য এই রচনার স্বত্ব সখীসমিতিকে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। টাকা তোলার জন্য মঞ্চসাফল্য সুনিশ্চিত করার তাগিদে, অথবা নান্দনিকতারই খাতিরে, অতগুলি মেয়েকে বিপন্ন করে তোলার মধ্যে, চাকচিক্য বাড়াতে চিয়ারগার্ল নামিয়ে দেওয়ার একটা চেনা গন্ধ আছে না? ইন্দিরার বয়ান: ‘... মায়াকুমারীদের দণ্ডের মুণ্ডে দগদগ করে বিজলিবাতি জ্বলছিল নিভছিল...’ আর সরলার বয়ান: ‘...মায়াকুমারীদের মাথায় অলক্ষ্য তারে বিজলীর আলো জ্বালান তাঁদের একটি বিশেষ কারিগরি ছিল। আর সবাই অতি ভয়ে ভয়ে ছিল পাছে বিজলীর তার জ্বলে উঠে মায়াকুমারীদের shock লাগে।’
আসল কথা হল, দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য নামাই চিয়ার পারি যে কৌশলে। মোকাম কলকাতার সাবেকি পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অঙ্ক ও দৃশ্য পরিবর্তনে বিস্তর সময় লাগত। শ্মশানের সিনে প্রায়ই নেমে আসত নন্দনকাননের ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু বাবুদের উত্তেজনা শিথিল হয়ে পড়লে তাঁদের সামলানো ভারী কঠিন, তা মঞ্চের ম্যানেজাররা হাড়ে হাড়ে বুঝতেন। নাটকে কমা, সেমিকোলন, হাফ-ফুলস্টপ ফেলতে গেলে তাই উইংসের ধারে রিজার্ভ বেঞ্চে তৈরি রাখতে হত সখীর দলকে। সখীরা আসতেন, গাইতেন, নাচতেন বেশ চড়া সুরের গানে, প্রোভোক করার মতো পোশাক আর মেক-আপে। আবার সখীর নাচ যদি তেমন জমে যেত, তাতেও উলটো বিপত্তি। তখন মূল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রস্তুত হয়ে গেলেও যবনিকা তুলতে দেওয়া হত না। সখীদেরই নাচ চালিয়ে যেতে হত। অনেকে হায় হায় বলে কপাল চাপড়াতেন, কিন্তু যাঁরা টাকা ঢেলেছেন তাঁরা বেঁকে বসলে তো থিয়েটারের গণেশ উলটোবে। গ্রামেগঞ্জে মাঠেঘাটে বা ইদানীং মাল্টিপ্লেক্সের সাজানো উঠোনে যাঁদের আলকাপ দেখার সুযোগ হয়েছে, তাঁরা ব্যাপারটা বুঝবেন। পালার মাঝে দর্শক একটু ঝিমোলেই, সেকেন্ডারি সখীবাহিনী আবার টেম্পো তুলে দেয়। এই ঐতিহ্য মেনে যদি স্পনসরদের দাবিতে এক দিন রাহুল দ্রাবিড় পিচে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আর চিয়ারগার্লরা ঘুরে ঘুরে ছক্কার নাচটা তেরো বার নাচে, কেমন হয়?
|
|
|
|
|
|