|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
সাহেবধনী সম্প্রদায় তাদের গান |
|
সুধীর চক্রবর্তী |
কলকাতার কলেজে ‘বাংলার অধ্যাপক’ হয়ে দেড় বছর কাজ করতে না করতেই সরকারি কলেজের সম্ভ্রান্ত জগতে পা রাখি ১৯৬০ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগে ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের সম্পর্ক’ এমন কুলীন ও নাগরিক প্রসঙ্গ নিয়ে গবেষণা-সন্দর্ভের প্রথম বয়ান রচনা হয়ে গিয়েছে, হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে এসে যাওয়া এক গবেষণা বৃত্তির দাক্ষিণ্যে (বিষয়: ‘ফোক সংস নদিয়া’) জীবনধারা ও সন্ধানের অভিমুখ একেবারে উলটো দিকে চলে গেল। এ বারে শুরু হল দিগ্দারি, কতটুকুই বা জানি নদিয়া জেলাকে আর কী-ই বা এমন বুঝি লোকসংগীতের অন্তর্জগৎ? তবু বেরিয়ে পড়লাম। অন্তত গানবিদ্যাটা আয়ত্তে আছে, বিদ্যেবুদ্ধির আত্মগরিমাও কি নেই? অবশ্য যেটা জানতাম না, তা হল পল্লিজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলা গানের ধারাস্রোতের বিচিত্রতার স্পন্দমান জগৎ। এটাও অজ্ঞাত ছিল, এবড়োখেবড়ো ভাঙাচোরা খানা-খন্দ ঘেরা পথে কতটাই না হাঁটতে পারি! শহর থেকে বাসে চড়ে কোনও এক জায়গায় নেমে তার পরে খোঁজ করতে করতে হাঁটা। মাঝে মাঝেই গ্রামের মানুষের ভিটেতে সাদর অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন। তাঁদের সঙ্গেই থাকা-খাওয়া, গান গাওয়া, গান শোনা মধ্য রাতে। তাঁরাই হদিশ দিচ্ছেন কোথায় গেলে গান পাব, কোন আখড়ায় আছে হাতে লেখা গানের খাতা, কোন সাধকগায়ক বা ফকির বোঝাবেন গানের মর্ম, চান্দ্রমাস অনুসারে কোন তিথিতে কোথায় বসে বাউল ফকিরদের মেলা।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত দুই বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে লোকধর্ম ও গৌণধর্মীদের গান সংগ্রহ করতে গিয়ে চোখের সামনে খুলে গেল যে জীবনসত্য, তা আমার পুঁথিপড়া জ্ঞানবিদ্যার অহমিকাকে বারে বারে ভেঙে দিল। সংগৃহীত শত শত গানের অন্তর্গত অর্থ বিশ্লেষণ করতে করতে ক্রমে ধরতে শিখি তার গূঢ়ার্থ ও সন্ধ্যাভাষার দ্যোতনা। তার মধ্যেই আবিষ্কার করি উদার আত্মনির্ভর এক লোকসমাজ, যাদের মধ্যে আছে বিদ্যমান শ্রেণিবর্ণবর্গের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনা ও উন্নত মানবধর্ম, ‘মানুষ মানুষ সবাই বলে— কে করে তার অন্বেষণ’: তাঁদের গানে গানে ব্যক্ত মূল জিজ্ঞাসা।
ততটা প্রকাশ্য নয় এমন সব গৌণধর্মী সম্প্রদায়কে সরেজমিনে যে আমিই প্রথম খুঁজতে চেষ্টা করেছি, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন থেকে শশিভূষণ দাশগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও মনসুরউদ্দিন, এইচ এইচ উইলসন, যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আগেই এ সব সম্প্রদায়কে বুঝতে চেয়েছেন বা সংগ্রহ করেছেন তাঁদের গান। তবে নানা বর্গের নানা গৌণ সম্প্রদায়গত গানকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে না পেরে ‘বাউল’ এমন এক জেনেরিক সংজ্ঞায় তাঁরা ফেলে দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে তথ্যভিত্তিক ও কুতূহলী গবেষণার কাজটি করে গিয়েছেন ১৮৭০ সাল বরাবর অক্ষয়কুমার দত্ত, তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইয়ের দুই খণ্ডে। হয়তো সম্পূর্ণত বা বিস্তৃত অনুসন্ধানলব্ধ সরেজমিন কাজ নয়, তবু তিনি বেশ নৈপুণ্যের সঙ্গে বিধিবদ্ধ ভাবে সর্বপ্রথম অনেকগুলি লোকায়ত গৌণধর্মের প্রাথমিক প্রতিবেদন লিখে গিয়েছেন। সেই সব সম্প্রদায়ের মধ্যে কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী ও খুশিবিশ্বাসীদের প্রসঙ্গ আমার গবেষণা প্রকল্পের নদিয়াকেন্দ্রিকতার সঙ্গে যুক্ত হল, যেহেতু এই চারটি সম্প্রদায়ের উৎস, সাধনকেন্দ্র ও গুরুপাট অখণ্ড নদিয়া জেলাতেই। শুরু হল এ বার তাঁদের খোঁজ।
তত দিনে বেশ ক’বছর কেটে গিয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শেষ। কিন্তু সন্ধানপর্ব যে অশেষ। সাহিত্যবোধ, সংগীতজ্ঞান, ইতিহাস বা সমাজবিদ্যার পাঠে মনে হল সবটা ধরা যাচ্ছে না। তখন ড. সুরজিৎ সিংহ-র দ্বারস্থ হলাম। নৃতত্ত্ববিদ সেই সহৃদয় মানুষটি আমার কাণ্ডকারখানা দেখে দীক্ষা দিলেন সমাজ-নৃতত্ত্বে আর সমাজবিজ্ঞানে। বইপত্র জোগাড় করে দিলেন। দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশাল সায়েন্স রিসার্চ’ থেকে নিজের উৎসাহে এক গবেষণাবৃত্তি এনে দিয়ে জুড়ে দিলেন বৃহত্তর কাজে। যাকে বলে মেথডোলজি, তা আয়ত্ত হল। তার পর ঠোকাঠুকি লেগে গেল অধীত বিদ্যা ও তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব পায়ে-হেঁটে দেখা নানা অভিজ্ঞতার সত্যের। গৌণধর্মীদের প্রতি দিনের কঠোর দিনযাপন, উচ্চ বর্গের ঘৃণা, তাঁদের প্রতিবাদ ও গোপনতার আড়াল, যুগলসাধনা, দেহতত্ত্বের গান— এ সব তো পরতে পরতে গাঁথা। বই পড়ে কি তার সমাধান হয়?
আমি তাই সার্বিক অনুসন্ধানের ব্যাপক পথ ছেড়ে বেছে নিলাম এক-একটা গৌণধর্মের নিজস্ব বৃত্ত। তার গোড়াতেই এল কর্তাভজা ও সাহেবধনীদের মিলিয়ে দেখা। দুটো ধর্মের প্রাণকেন্দ্র বা প্রবর্তকের বাস্তু আলাদা। তাই কর্তাভজাদের কথা আর গান বুঝতে বার বার যেতে লাগলাম কল্যাণীর ঘোষপাড়ায়, বিশেষ করে রংদোলের আগে-পরে দিন তিনেক ধরে সতী মা-র মেলায়। সেখান থেকে সংগ্রহ করলাম অনেক গান আর তার তত্ত্বভিত্তি। খুঁজেপেতে জড়ো করলাম কর্তাভজাদের সম্পর্কে মুদ্রিত আর প্রকাশিত অনেক বই বা পত্রিকার প্রতিবেদন। সাহেবধনীদের ব্যাপারটা অত সহজপ্রাপ্য ছিল না। তাঁদের সম্পর্কে একমাত্র সম্বল ছিল অক্ষয়কুমার দত্ত-র লেখা শীর্ণ, কবেকার এক প্রতিবেদন। সাহেবধনীদের খোঁজে তাই চলে গেলাম তাঁদের গুরুপাট নদিয়া জেলার চাপড়া থানার অন্তর্গত বৃত্তিহুদা নামের এক প্রায় অগম্য গ্রামে। স্রেফ পায়ে-হাঁটা, নোংরা, পূতিগন্ধময় এবং জলাঙ্গী নদীর ধার ঘেঁষে চলা কঠিন সেই পথ। খেটে খাওয়া মানুষজন, কয়েক ঘর তাঁতি, বেশ ক’টি গোপবংশীয় পরিবার ও গরিব মুসলমানদের আবাস। কিন্তু গানে গানে মুখরিত। সে সব গান লিখে গেছেন জনৈক কুবির গোঁসাই আর তাঁর শিষ্য যাদুবিন্দু গোঁসাই। শত শত গান, সেই গানের খাতা হাতে নাড়াচাড়া করতে পারা যাবে, পড়া যাবে, কিন্তু কপি করা যাবে না। টানা পাঁচ বছর মাঝে মাঝেই সেই অজ বৃত্তিহুদা গাঁয়ে যাই আর ফিরে আসি। কুবিরগীতির হাতে-লেখা ১২০৯ গানের পাণ্ডুলিপি পড়ি, লোভী চোখে তাকাই, টের পাই বারান্দা থেকে জানলা দিয়ে নজর রাখছে খর চোখ। যাদুবিন্দুর বাস্তুভিটে ছিল বর্ধমানের পাঁচলখি গাঁয়ে। কবে মরে হেজে গিয়েছেন, এখন রয়েছেন মরা গরিব বংশধরেরা। যাদুবিন্দু নামটা জোড়কলম। বিন্দু তাঁর সাধনসঙ্গিনীর নাম। গানে পড়লাম— যাদু বিন্দু এঁরাই দুজনা/ পাঁচলখি গাঁয় তার ঠিকানা। তাঁর গানও জোগাড় হল। অলৌকিক ভাবে পাঁচ বছর পরে কুবিরের খাতাও হাতে এল। পেয়ে গেলাম সাধনভজনের গোপন পুঁথি, মন্তরতন্তর, কবচ তাবিজের সংকেত। এ বার তাই কোমর বেঁধে লিখতে বসে গেলাম ‘সাহেবধনী সম্প্রদায় তাদের গান’। একটানা লেখা হয়ে গেল। অভিনব ঘটনা তো বটেই— সম্পূর্ণ অজানা এক জগৎ, বিচিত্র তাঁদের বিশ্বাস আর ধরনধারণ। হিন্দু-মুসলমানে ভেদ নেই। জাতপাত বর্ণবিভেদ যাঁদের অচেনা। কেমন অনায়াসে তাঁরা গেয়ে ওঠেন— আল্লা আলজিহ্বায় থাকেন আপ্তসুখে/ কৃষ্ণ থাকেন টাকরাতে। আবার: পিতা আল্লা মাতা আহ্লাদিনী/ মর্ম বোঝা হল ভার। এমন সম্মেলনকামী অপরূপ বিশ্বাসের অণুবিশ্বের বার্তা কি আমার কলমেই তবে বাঙালি প্রথম জানবে?
বিশ পঁচিশ বছর ধরে আমার শত শত পল্লিপরিক্রমা আর গৌণধর্মীদের শিকড় সন্ধানের রোমাঞ্চকর ও নাটকীয় বিবরণ আখ্যানের ধাঁচে লিখলাম বন্ধু নির্মাল্য আচার্য-র ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় ১৩৯১-এর শারদ সংখ্যায়, যার শিরোনাম ছিল ‘মনের মানুষের গভীর নির্জন পথে’। হইহই পড়ে গেল। পিঠোপিঠি লিখে ফেলি ‘সাহেবধনী...’ বইটি। ভাবতে পারিনি এত সাড়া জাগাবে এমন একটা অজানা জগতের কথাকল্প। পত্রপত্রিকায় সমালোচকরা স্বাগত জানালেন আবেগপূর্ণ ভাষায়। মনে আছে, সবচেয়ে মৌলিক ভাবে বইটির অন্তঃস্বরূপ ধরতে পেরেছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর মুগ্ধ আলোচনা দীর্ঘ আকারে বেরোয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। আর থামিনি। পঁচিশ বছরের প্রস্তুতি আর সঞ্চয় নিয়ে এর পরে পরে ক’বছর ধরে বেরিয়ে গেল ‘বলাহাড়ি সম্প্রদায় আর তাদের গান’, ‘গভীর নির্জন পথে’, ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ আর ‘বাউল ফকির কথা’। সংকলন করলাম ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ আর ‘জনপদাবলি’। সব মিলিয়ে আমার এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠাভূমি আর লেখক পরিচয় গড়ে উঠল। ‘সাহেবধনী...’ বইটি হল আমার গভীর নির্জন পথে যাত্রাপথের প্রথম অভিজ্ঞান। যখন বেরোয় তখন আমার বয়স পঞ্চাশ বছর। লেখকরূপে নিজেকে তৈরি করে তুলতে এত বছর লাগল? মাঝে মাঝে ভাবি আর বইটা দেখি।
কৃতজ্ঞতা: প্রদীপ বিশ্বাস
|
|
|
|
|
|