বেঁচে গেল পাঁচুগোপাল
প্রাণটা এক মুহূর্তের অসর্তকতায় প্রায় খোয়া যাচ্ছিল। বর্তমানে অর্ধ-মূর্ছিত পাঁচুগোপাল বিছানায় শুয়ে। পাশে পাঁচুর বউ ময়নামতি জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, ‘ওগো, বলো না, এমনটা হল কেমন করে?’ উত্তর দেওয়ার মতো বল নেই পাঁচুর শরীরে। পাঁচুর মুখ দিয়ে একটিই শব্দ বেরোচ্ছে ‘রাম রাম’। এটা গোঙানির মতোই শোনাচ্ছে। উত্তর না পাক অমন ক্ষীণ অস্পষ্ট উচ্চারণ শুনে ময়নামতি পাঁচুর অবস্থা বুঝে ফেলেছে।
পাঁচুর গ্রামের নাম ভূতগ্রাম। আসলে গ্রামের নাম ধূলিগাঁও। ধু ধু বালির ওপর বলে ধূলিগাঁও। গ্রামে না আছে বিজলি না আছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। চারিদিকের গ্রামে যখন ঘরে ঘরে বিজলিবাতি জ্বলে, তখন এ গ্রামে ঘরে ঘরে কেরোসিনের ভৌতিক আলো টিমটিম করে।
গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই ভূতের ভারী উপদ্রব। গরমে রাতে বাইরে শুয়ে থাকলে প্রথম প্রথম চাদর বা কাঁথা অদলবদল হত। পরে আস্ত মানুষ। একটা অজানা আতঙ্ক গ্রামকে ঘিরে রেখেছে।
গ্রামে টয়লেট-বিহীন মানুষেরা মাঠে ঘাটে বড় বাইরে সারে। কয়েক দিন বাদে এই টয়লেটরত মানুষকেই পাঁচুর বাড়ির সামনের মাঠে ঘাড় গোঁজা অবস্থায় পাওয়া গেল। ডাক্তার বলল হার্ট অ্যাটাক। পর পর কয়েক জন এ ভাবে মারা যাওয়ার পর মানুষ ওঝা-ফকির, গ্রাম-বন্ধন, ভূততারণ যজ্ঞ অনেক কিছু করল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে শেষে পঞ্চায়েতের দারস্থ হল। সিদ্ধান্ত হল, যত দিন না গ্রামে বিদ্যুৎ আসে তত দিন ওই ডেথ ট্র্যাপে একটা সাইনবোর্ড টাঙানো হবে ‘ভূত হইতে সাবধান’। টাঙানোও হল। আবার ক’দিন বাদে কারা যেন ওটাকে তুলেও নিয়ে গেল।
সন্ধের পরে তখন মাঠে কেউ আর একা একা বড় বাইরে করতে যেত না। ক্রমে গ্রামের অবস্থা স্বাভাবিক হল। ফলে, বিদ্যুতের খুঁটিতে তার ঝুলল না। গ্রামে আর আলোও জ্বলল না, ভূতও নড়ল না। এ কথা কেউ জানলও না। পাঁচুও জানত না।
ছবি: সুমন চৌধুরী
সে দিন পাঁচু দাওয়ায় একা একা শুয়ে আছে। বাইরে হঠাৎ প্রবল ঝড় উঠেছে। পাঁচুর ঘুম ভেঙে গেল। মাটির দেওয়াল তালপাতার চালা। দরজাও তাই। পাঁচুর ঘরের সামনের জাম গাছটা যেন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ঝড়ে, অথচ তালপাতার দরজা বা চালা কিছুই নড়ছে না। পাঁচুর মনে খটকা লাগল। পাঁচু কোমরে জালের কাঠিটায় হাত ছোঁয়াল। ভূতের প্রতিকার হিসেবে গ্রামে অন্যান্যদের মতো পাঁচুও কোমরে এটাকে বেঁধেছে। হঠাৎ পাঁচুর পেটে কামড়। পেট একেবারে গুলিয়ে উঠেছে। ঠেকিয়ে রাখা দায়। কোনও রকমে মগে জল ভরে পাঁচু মাঠে ছুটল। কোথায় ঝড়! ফুটফুটে জ্যোৎস্না। খণ্ড খণ্ড মেঘ আকাশে। তারই আড়ালে সোনালি চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। পাঁচু একটু দূরে লক্ষ করল একটা ষাঁড় ঘাস খাচ্ছে। আরও একটু ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ষাঁড় কোথায়? ওটা তো ঘোড়া। আরে, সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে গাড়োয়ান। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। গাড়োয়ানের পিছনে একটা বিশাল নৌকা। পাঁচু চোখ টান টান করে দেখতেই থাকল। গাড়ি, ঘোড়া কোথায়? মানুষটাই তো বিশাল নৌকাটা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। ওটা কি নৌকা, নাকি ঘাসের বোঝা? এ তো দেখছি ঘাসের বোঝা মাথায় ছোট-বড় মানুষের মিছিল। মাথায় বোঝা মানুষেরা লম্বা হয়ে যাচ্ছে...। পাঁচুর দৃষ্টি শূন্যে উঠছে...। মানুষেরা লম্বা হতে হতে সব তালগাছ। পাঁচু ভারী মজা পেল। পাঁচু অনেক বিদ্ঘুটে ভূতের গল্প শুনেছে, কিন্তু এমন ভৌতিক কাণ্ড কখনও দেখেনি।
কেঁ র্যাঁ?
খোনা গলা শুনে পাঁচুর সংবিৎ ফিরল। ভাল করে চারিদিকটা দেখল। কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না, অথচ কারা যেন নড়ছে, ফিসফিস করছে। পাঁচু থতমত খেয়ে বলল, তো-তোমরা কারা গো?
তুঁই কেঁ?
আ-আমি পাঁচু। তোমরা কারা?
আঁমরা তোঁমার আঁত্মীয় গোঁ। তাঁ এঁখানে কীঁ কঁরচ?
এই একটু ইয়ে...
তাঁ এঁই অঁসময়ে?
প্যাটটা যে মোচড় দিয়ি উঠল।
এঁখন যঁদি তোঁমার ঘ্যাঁটিটায় মোঁচড় দিঁই?
এই রে! পাঁচুর যেন আরও এক বার বেগ এসে গেল। এই গরমেও পাঁচুর হাতে-পায়ে কাঁপুনি ধরেছে। তবু পাঁচু মাথা ঠান্ডা রেখে সটান ঘরের দরজায়। এ অবস্থায় নাকি পিছু ফিরে তাকাতে নেই। পাঁচুও তাকায়নি। শুধু আসতে আসতে পাঁচু শুনতে পেল কঁপাল ভাঁল। এঁ যাঁত্রায় বেঁচেঁ গেঁলি। নঁইলে আঁমাদের চাঁরণভূমি অঁপবিত্র কঁরা বেঁর কঁরে দিঁতাম।
পাঁচু এখন প্রায় সুস্থ। ডাক্তারবাবু, পঞ্চায়েতের লোকজন পাঁচুর বাড়িতে এসেছিল। পাঁচুর বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে নতুন একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে ‘মাঠে ঘাটে নয় আর/ঘরে ঘরে শৌচাগার’।
পঞ্চায়েত থেকে বিনা পয়সায় এই গ্রামের ঘরে ঘরে শৌচাগার দেওয়া হবে। এই গ্রামকে নির্মল গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পাঁচুর খুব আনন্দ প্রথম শৌচাগারটি তার বাড়িতেই বসবে। প্রধানসাহেব কথা দিয়েছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.