প্রবন্ধ...
অভিশপ্ত স্বর্গ
ই সেই রাস্তা? এটাই পৌঁছে গিয়েছে দুনিয়ার উচ্চতম রণক্ষেত্রে? একটু আগে পেরিয়ে এসেছি সেই ফলক। ‘ওয়েলকাম টু খারদুং লা। দ্য হায়েস্ট মোটরেব্ল রোড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’ নেমে ছবি তোলা, সেনা চেকপোস্টে পারমিট দেখানো। আর, তখনই আঠারো হাজার ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে এক ফৌজি জওয়ান দেখালেন, ‘‘ওই দেখুন। ও পাশটা হিমালয়। এ দিকে কারাকোরাম।”
চড়াই থেকে প্রায় চোদ্দো হাজার ফুটে নেমে দেখা গেল, ডান দিকে নীল জলের এক নদী। শরতের আকাশের মতো হাল্কা নীলাভ রং। নদীর নাম শিয়ক, এখান থেকে চলতে চলতে তার্তুক নামের এক জায়গায় সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সিন্ধু নদের বুকে। জায়গাটা দেখার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। ওটি ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখায়।
খারদুং, খালসার... ছোট ছোট সব গ্রাম। এখন আর আমরা পাহাড়ে নেই, জিপ চলছে শিয়কের ধারে বিশাল সমভূমিতে। খালসার ছাড়িয়ে দু’দিকে দুটো রাস্তা। একটা রাস্তা চলে গিয়েছে হুন্ডার, ডিস্কিট অঞ্চলে। সেখানে দেখা যায় দুই কুঁজওয়ালা ব্যাকট্রিয়ান উট, এ দেশে যা দুর্লভ। অন্য রাস্তা ডান দিকে। পানামিক, সুমুর হয়ে সাসোমা। তার পর সিয়াচেন বেস ক্যাম্প।
সিয়াচেনের পারমিশন আমাদের নেই। লে’তে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে যেতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পারমিশন লাগবে। অনেক ধরাধরির পরে কয়েক ঘণ্টার জন্য পানামিক যাওয়ার অনুমতি মিলল। শর্ত একটাই। বিকেলের মধ্যে ডিস্কিটের হোটেলে ফিরতে হবে।
প্রশস্ত রাস্তা, সামনে ছুটে যাচ্ছে আর্মি ট্রাক। কিন্তু ট্রাকের সামনে এত জটলা কীসের? এগিয়ে বোঝা গেল, ট্রাকটি আসলে চলমান দোকান। ভিতরে বিভিন্ন খোপে ময়দা থেকে সুজি, বিস্কুট, খাতা, পেন্সিল... বেঁচে থাকার জন্য গ্রামের লোকেরা এই সব ট্রাকের ওপর নির্ভর করেন।
মাথার ওপরে উড়ে যাচ্ছে ফৌজি হেলিকপ্টার। লাদাখে থাকতে থাকতে আওয়াজটায় এখন অভ্যস্ত। আগের দিন বেড়াতে গিয়েছিলাম স্পিতুক গোম্ফায়। লে বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে গোম্ফায় যাওয়ার খাড়াই রাস্তা, পাহাড়ের খাঁজে কার্বাইনধারী কম্যান্ডো। ওই যে বিমানটা নামছে, ওটাই তো মিগ! আরে, ওটা? মিরাজ ফাইটার না?
নিঃসঙ্গ সাঁজোয়া হেলিকপ্টার দেখেছিলাম প্যাঙ্গং সো-র আকাশেও। লে থেকে বেরিয়ে এক দিন দুনিয়ার তৃতীয় উচ্চতম ‘মোটরেব্ল পাস’ চাং লা পেরিয়েছিলাম। গিরিপথ পেরিয়ে আরও ঘন্টা দুয়েক ড্রাইভ করে প্যাঙ্গং সরোবর। আচমকা আকাশে দেখবেন উড়ন্ত কপ্টার। সরোবরের দুই-তৃতীয়াংশ চিনে, বাকিটা ভারতে।
প্যাঙ্গং সরোবরের ধারে রাত্রিবাস নিষিদ্ধ, ফলে আমরা ছিলাম তাংসে গ্রামে। বিপুল গর্জনে বয়ে যাচ্ছে তাংসে নালা। ছোট্ট, বরফগলা ঝরনা থেকে বেরিয়ে ফের পাহাড়ি পথে অন্য নালায় মিশেছে। সারচু পাহাড়ে সারচু নালা, পাং পাহাড়ে পাং নালা। উইকিম্যাপিয়া বা গুগ্ল আর্থ-এ এই নালাগুলি খুঁজে পাবেন না। এদের চিনতে লে শহর পেরিয়ে লাদাখের অভ্যন্তরে কয়েক রাত কাটাতে হবে। যে রাকি নালা পেরিয়ে চিনে সৈন্যরা আজ তাঁবু গেড়েছে, সেটিও এই জাতীয় স্রোতস্বিনী।
লাদাখ গুরুত্বের, কেন না এক দিকে পাকিস্তান, অন্য দিকে চিন। আমাদের উচ্চতম গিরিপথে শুধুই ফৌজি ট্রাক ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ট্যুরিস্টদের আনাগোনা। কিন্তু চিনের সহযোগিতায় লাহোর অবধি পৌঁছে গিয়েছে যে ‘কারাকোরাম হাইওয়ে’, সেটি আজ পাকিস্তানের অন্যতম বাণিজ্যপথ।
পানামিকে একটি গুম্ফা, উষ্ণ প্রস্রবণ। এবং বিশাল সেনা-হাসপাতাল। কুড়ি হাজার ফুটের সিয়াচেনে তুষারক্ষত, শ্বাসকষ্ট, নানা অসুখে ভোগেন ভারতীয় সেনারা। তখন তাঁদের পানামিকের হাসপাতালে নামিয়ে আনা হয়। ভারত-পাকিস্তান দুই তরফে সিয়াচেনে যত না সৈনিক যুদ্ধে মারা গিয়েছেন, তার চেয়েও বেশি হাই অল্টিচ্যুড সিকনেসে।
সিয়াচেনে কী আছে? বিশাল হিমবাহ, সেখানেই উনিশ হাজার ফুট উঁচু আটচল্লিশটি শিখর, তার মাত্র ষোলোটির নাম দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলি এখনও নামহীন। সল্টোরো রিজ নামটা পরিচিত। সেটি এক গিরিশিরা, সেখানেই আঠারো হাজার ফুট উঁচু ‘বাইফন্ড লা’ ভারতীয় বাহিনির দখলে। ওটিই NJ 9842-র প্রধান স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট।
NJ 9842 নামের বিন্দুটি চিনের গায়ে গায়ে। ১৯৪৯ সালে পাক-ভারত যুদ্ধশেষে নিয়ন্ত্রণরেখার কথা ওঠে। দুই দেশের মধ্যে ঠিক হয়, জম্মু অঞ্চল থেকে নিয়ন্ত্রণরেখা শুরু হয়ে ওই বিন্দুতে শেষ হবে। তার পর, উত্তর দিকে হিমবাহ। এটাই বেশ গোলমেলে কথা। ১৯৭৭-এ ভারতীয় বাহিনীর কর্নেল নরেন্দ্রকুমারের হাতে একটি মানচিত্র আসে। সেই মানচিত্রে দেখলেন, NJ 9842 থেকে সরলরেখা সোজা হিমবাহে যায়নি। বেঁকে পাকিস্তানি কারাকোরামের দিকে চলে গিয়েছে। জানা গেল, ১৯৭৩ থেকে পাকিস্তান জাপান, অস্ট্রিয়া, আমেরিকার অভিযাত্রীদের হিমবাহে যাওয়ার পারমিট দিচ্ছে। ফলে দুনিয়ার ধারণা, হিমবাহটি পাকিস্তানের অধীনে। আজও রাষ্ট্রপুঞ্জে সিয়াচেন নিয়ে কথা উঠলে পাকিস্তান ওই যুক্তিই দেখায়। তারা ভারতের আগে থেকে ওই এলাকায় অভিযানের পারমিট দেয়।
নরেন্দ্র তাঁর ওপরওয়ালা লেফটেনান্ট জেনারেল চিব্বেরকে ঘটনাটা জানালেন। লাদাখ স্কাউটের চল্লিশ জন পর্বতারোহী ও ত্রিশ জন পোর্টারকে নিয়ে সিয়াচেন পৌঁছে দেখা গেল, জাপানি মাউন্টেন গিয়ার। সঙ্গে পাকিস্তানি বিয়ারের ক্যান ও সিগারেটের প্যাকেট।
আশির দশকের শুরুতেই নরেন্দ্রর নেতৃত্বে সাল্টোরো রিজ এবং বাইফন্ড লা দখল করল ভারতীয় সেনা। একটা ব্যাপারে এগিয়ে ছিল ভারত। তুষাররাজ্যে সৈন্যদের থাকার ব্যবস্থা। আন্টার্কটিকা অভিযানে ব্যবহৃত ফাইবার গ্লাসের ইগলু নিয়ে গিয়েছিলেন কুমাররা। পাকিস্তানি কর্নেল মহম্মদ ফারুক আলতাফ অতঃপর হেলিকপ্টারে চেপে তুষাররাজ্যে। “আমি দু’নম্বর কপ্টারে ছিলাম। আচমকা প্রথম কপ্টারটা টার্ন নিল, এক জন গুলি ছুড়ছে। পরে বেস ক্যাম্পে পৌঁছে দেখলাম, রোটরে বুলেটের গর্ত। সিয়াচেনে প্রথম বুলেট ওটাই। ইন্ডিয়ানরা আমাদের এক সপ্তাহ আগে পৌঁছে গিয়েছিল,” পরে ইন্টারভিউতে দুঃখ করেছেন ফারুক।
সেই কাহিনি আজও। কখনও সিয়াচেন, কখনও বা রাকি নালা। সে বার পানামিক ছাড়িয়ে একটা ঝোপে ড্রাইভার দেখালেন বুনো ফুল। গোলাপের মতো। “এগুলিই সিয়া। আর চেন মানে, প্রচুর।” সিয়াচেন মানে প্রচুর গোলাপ।
সেখানেই উপমহাদেশের ট্রাজেডি। লে বিমানবন্দরের পাশে যে স্পিতুক গোম্ফা, সেটি হেমিসের চেয়েও পুরনো। পশ্চিম তিব্বতের রাজা এক দিন বাইয়াং চুব ওড নামে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তাঁর দাদা ওড ডে তৈরি করেছিলেন এই গোম্ফা। রাজার গুরু ছিলেন বাঙালি। অতীশ দীপঙ্কর। (ভারতীয় ভিক্ষু কেন অন্য দেশের নৃপতিকে দীক্ষা দেবেন, এ চিন্তা হাজার বছর আগের সেই পৃথিবীতে ছিল না।) ওই গোম্ফা থেকে সিয়াচেনের রাস্তায় যাওয়া তাই জরুরি ছিল।
এখন গোম্ফার সামনে ফাইটার বিমানের ওড়াউড়ি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.