সারদা-তদন্ত যত এগোচ্ছে, জালিয়াতির নতুন নতুন উৎসের সন্ধান মিলছে। যা দেখে চোখ কপালে উঠছে তদন্তকারীদের।
সিবিআইকে পাঠানো চিঠিতে সারদা-কর্ণধার লিখেছিলেন, ৯৯.৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আমানতকারীদের পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য বিশদে নথিভুক্ত হত না। কেবল নাম-ঠিকানাই লেখা হত। মানি মার্কেটিং সংস্থাগুলি এই নিয়মেই ব্যবসা করে বলে চিঠিতেই লিখেছিলেন সুদীপ্ত সেন। পরের দিকে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন, ওই নিয়মের সুযোগ নিয়েই তাঁর সংস্থার কিছু কর্মী আমানতকারীদের জমানো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেয়েছিলেন সুদীপ্ত। কয়েক হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্যের পতনের আভাসও পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও বিপুল খরচের বহর কমিয়ে বা সম্পত্তি বিক্রি করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেননি তিনি। আগের মেজাজেই পয়সা উড়িয়েছেন দু’হাতে! জেরার গোড়ার দিকে পুলিশকে এ সব কথা বলেওছিলেন ‘সেন স্যার’।
সংস্থারই কিছু কর্মী আমানতকারীদের একাংশের টাকা হাতাচ্ছে, প্রথম দিকে সুদীপ্তর এই দাবি বিশ্বাসই করেননি তদন্তকারীরা। পরে তাঁদের ভুল ভাঙে। কী ভাবে? এক পুলিশকর্তা বলেন, “১৫ এপ্রিল অর্থ তছরুপের বিষয়টি জানাজানি হয়। তার আগেই অবশ্য কলকাতা থেকে পালিয়ে যান সুদীপ্ত। এক দিকে তাঁকে খোঁজা হচ্ছিল, পাশাপাশি তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ারও প্রস্তুতি চলছিল।” তদন্ত শুরু করেই পুলিশ ওই সংস্থার কম্পিউটার ব্যবস্থার মূল সার্ভার দখলে নিয়ে নজরদারি শুরু করে। কিন্তু তার পরেও তদন্তকারীরা যখন দেখেন একাধিক জেলায় কম্পিউটারের মাধ্যমে আমানতকারীদের নাম তোলার কাজ চলছে, তখনই তাঁরা নড়েচড়ে বসেন। পরে দেখা যায়, ১৬ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে (তত দিনে সারদার কেলেঙ্কারির খবর শুধু এ রাজ্যে নয়, গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে) হাজার খানেক আমানতকারীর নাম উঠেছে সারদার নথিতে! এর পরেই পুলিশ ভুয়ো আমানতকারীর নাম তোলার বিষয়ে এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়। |
২০০৯ সালে সায়েন্স সিটিতে সারদার কয়েক জন এজেন্টের সঙ্গে সুদীপ্ত সেন। |
তদন্তকারীরা সুদীপ্তর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন সারদা এ ভাবে ভেঙে পড়ল? সারদা মালিকের বক্তব্য, ‘চেন মার্কেটিং’য়ের ব্যবসায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক, নতুন টাকার জোগান। দুই, এজেন্টদের কর্মদক্ষতা। এজেন্টরা যত বেশি আমানতকারী আনতে পারবেন, তত ভাল চলবে সংস্থা। কিন্তু গত দু’বছরে সে ভাবে নতুন টাকার জোগান আসেনি বলে পুলিশকে জানিয়েছেন সুদীপ্ত। একাধিক বার তিনি পুলিশকে বলেছেন, শুধু যে তাঁর পরিচালনার অদক্ষতার কারণেই সংস্থা ধসে পড়েছে, তা নয়। যে ‘বিশ্বস্ত’ কর্মীদের উপর তিনি নির্ভর করতেন, তাদের বিশ্বাসঘাতকতাও সারদা সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরাণ্বিত করেছে।
বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষ শনিবার বলেন, “এখনও পর্যন্ত ১০০টি শাখায় ২১০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ করা গিয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। এ ছাড়াও ৪৫০ বিঘা জমির হদিস মিলেছে। তার বেশ কিছু কেনা হয়েছে ত্রিপুরা, অসম ও ওড়িশার বালেশ্বরে।” মিলেছে কয়েকশো গাড়ির সন্ধান। তবে এখনও পর্যন্ত সুদীপ্তর নিজস্ব অথবা সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি থেকে টাকার লেনদেনের যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা-প্রধান। তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের কাছে এই সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেগুলি পেলেই পুরো ছবিটা পরিষ্কার হবে।
সারদা-প্রধানকে এই ক’দিন জেরা করার সুবাদে পুলিশ বলছে, ‘পঞ্জি-পতি’ সুদীপ্ত সেন রীতিমতো মেজাজি লোক। পুলিশকে বলেছেন, কয়েক হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য যে ধসে পড়তে চলেছে, তা এক বছর আগেই টের পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খরচ কমিয়ে বা সম্পদ বিক্রি করে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও চেষ্টাই করেননি! তাঁর দর্শন ছিল, যে দিন সব ভেঙে পড়বে, সে দিন ভাবা যাবে। তার আগে ‘লাটসাহেবি’ কমানোর প্রয়োজন নেই! পুলিশের অনুমান, সেই কারণেই কর্মীদের বেতন বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ টেরই পাননি যে, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে চলেছে সারদা।
শুক্রবার রাত থেকে সুদীপ্তবাবুর পাশাপাশি দেবযানী মুখোপাধ্যায় ও অরবিন্দ চৌহানকে জেরার সময় বাড়িয়েছে পুলিশ। তবে এখনও পর্যন্ত তাঁদের এক সঙ্গে জেরা করা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, জেরায় সুদীপ্ত বলেছেন, কাশ্মীরে এক-দু’দিন কাটিয়ে লে হয়ে লাদাখ যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। কেন? সুদীপ্তর বক্তব্য, ওই সব ট্যুরিস্ট স্পটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মানুষ যান। ফলে ভ্রমণার্থী সেজে সেখানে কয়েক দিনের জন্য ডেরা বাঁধলে বা বাংলায় কথা বললে কারও সন্দেহ হবে না বলে মনে করেছিলেন তিনি। তবে সেই লুকোচুরির মধ্যেও যে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কাটা ছিলই, তা স্বীকারই করে নিয়েছেন অরবিন্দ। পুলিশ সূত্রের খবর, জেরায় অরবিন্দ বলেছেন, পালিয়ে বেড়ানোর সময় তিনি এক বার ‘সেন-স্যারে’র কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ধরা পড়ে গেলে কী বলবেন? সুদীপ্ত বলেছিলেন, “যা জান, সবই বলবে।”
প্রাথমিক জেরার পরে তদন্তকারীরা একটি বিষয়ে এক রকম নিশ্চিত। তা হল, গত ১০ এপ্রিল সুদীপ্ত ও দেবযানী এক সঙ্গে কলকাতা ছাড়েননি।
গোড়ায় পুলিশ দাবি করেছিল, ওই দু’জনকে নিয়ে অরবিন্দ চৌহান কলকাতা থেকে সড়কপথে রাঁচিতে গিয়েছিলেন। দেবযানীর বোন গোড়াতেই সে কথা অস্বীকার করে বলেছিলেন, জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে সুদীপ্তই তাঁর দিদিকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। শনিবার পুলিশ সে কথা মেনে নিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অসমেও সারদার অর্থ তছরুপের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে সিবিআইকে ওই মামলার তদন্তভার নিতে বলেছেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। শুক্রবার সিবিআইয়ের এক কর্তা বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের সঙ্গে দেখা করেন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। সারদা-কাণ্ডে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মামলা রুজু হওয়ায় তদন্তের সমন্বয়ের জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি ভাবে অবশ্য মামলা চালিয়ে যাবে বিধাননগর পুলিশ। শনিবার সিআইডি-র এডিজি শিবাজী ঘোষ বিধাননগরে গিয়ে রাজীব কুমারের সঙ্গে বৈঠক করেন। তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। |