একই আবাসনে হুবহু একই মাপের দু’টি ফ্ল্যাট। একটির দাম ৩৭ লক্ষ টাকা, অন্যটির দেড় কোটি।
৩১টি জায়গায় তৈরি হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। কিন্তু কাগজপত্র রয়েছে মাত্র পাঁচটির।
সারদা গোষ্ঠীর পাঠানো কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে এ রকম নানা অসঙ্গতি পেয়েছেন সেবি-র তদন্তকারীরা। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে তিন দফায় সারদা গোষ্ঠী মোট ৬৩টি পেটি ভর্তি করে এই সব নথি পাঠিয়েছিল বলে সেবি সূত্রের খবর।
সেবির তদন্তকারীদের কথায়, সারদার নথির ছত্রে ছত্রে অসঙ্গতি, গরমিল রয়েছে। যেমন সেবি সূত্রের খবর, প্রচুর প্রকল্প মাঝপথে বাতিল হয়েছে বলে দাবি করেছিল সারদা গোষ্ঠী। কিন্তু কবে কোন প্রকল্প বাতিল হল, কেন বাতিল হল, আমানতকারীদের কত টাকা কবে, কী ভাবে ফেরত গেল তার কোনও নথি ওই পেটি-পেটি কাগজ ঘেঁটেও মেলেনি। সেবির এক কর্তার কথায়, “পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে সারদার ল্যান্ডব্যাঙ্কে ঠিক কত জমি আছে, সেটা ওঁদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ছিল না, মানুষের কাছ থেকে কী ভাবে কিস্তিতে টাকা আসছে তারও অনেক কাগজ মেলেনি।” সেবির পূর্ণ সময়ের সদস্য রাজীব কুমার অগ্রবালের দেওয়া রিপোর্টেও এই সব কথাই জানানো হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের ‘ইকনমিক অফেন্স ইনভেস্টিগেশন সেল’-এর অভিযোগ (চিঠির ফাইল নম্বর২২১/ডি/ইওআই) পাওয়ার পরেই সেবি সারদার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। শুনানি চলাকালীন ২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেবির কলকাতা অফিসে সারদা গোষ্ঠী প্রথম দফায় ১৬ পেটি কাগজপত্র জমা দেয়। কিন্তু সেবির কর্তারা পরীক্ষা করে দেখেন, যা যা দিতে বলা হয়েছিল সারদা তার প্রায় কিছুই পাঠায়নি। কয়েক দিন পরে ১৭ সেপ্টেম্বর আবার ১৯ পেটি কাগজ পাঠায় সারদা গোষ্ঠী। তখনও দেখা যায়, দরকারি অনেক কাগজ তাতে নেই। ১৯ ডিসেম্বর সারদা আবার ২৮ পেটি কাগজ পাঠায়। সেই নথি পরীক্ষা করে ‘অপ্রয়োজনীয় বাজে কাগজ’ বলে জানিয়ে সেবি সেই ২৮ পেটি নথি ফেরত দেয়। |
সেবির তদন্ত রিপোর্টের প্রতিলিপি। |
এর পরে আরও ১৭০ পেটি কাগজ সেবির দফতরে পাঠাতে চেয়েছিল সারদা। সেবি রাজি হয়নি। তার বদলে চলতি বছরের ২৬ মার্চ সারদা প্রতিনিধিরা যেন বাছাই করা প্রয়োজনীয় কাগজ-সহ সেবির দফতরে হাজির হন, সেই মর্মে চিঠি দেয় সেবি। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই চিঠির কোনও উত্তর না পাওয়ায় সারদার অন্যতম এগজিকিউটিভ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আইনজীবী নরেশ বালোডিয়াকে বিষয়টি জানানো হয়। প্রসঙ্গত মার্চের শেষেই সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন তিন সদস্যের একটি ট্রাস্ট তৈরি করে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি সঁপে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। অজিতেশ এবং বালোডিয়া, দু’জনেই সেই ট্রাস্ট্রের সদস্য ছিলেন। তাঁদের কাছে সেবি-র চিঠি যাওয়ার পর অভিষেক রায় এবং সুদীপ্ত দে নামে দু’জন সারদা-র তরফ থেকে সেবির কলকাতা অফিসে আসেন। কিন্তু জেরার মুখে তাঁরা জানান, তাঁরা নিছক ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। সংস্থার আর্থিক লেনদেনের কিছুই তাঁদের জানা নেই।
সেবি বিষয়টি ফের অজিতেশবাবুকে জানায়। সেবির দাবি, ১ এপ্রিল সারদা গোষ্ঠী একটি চিঠি দিয়ে জানায়, তাদের বেশ কিছু কর্মী ও এজেন্ট দুর্নীতিগ্রস্ত। তাঁরা সংস্থার নামে জাল রশিদ ছাপিয়ে জনসাধারণের থেকে টাকা তুলছে। সংস্থার সার্ভারও তাদের দখলে চলে গিয়েছে। ফলে বহু কোটি টাকা এবং আমানতকারীদের নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই চিঠির পর সারদা গোষ্ঠী আর কোনও যোগাযোগ করেনি, কোনও রকম কাগজ বা প্রতিনিধি পাঠায়নি বলে জানিয়েছে সেবি। এ ব্যাপারে অজিতেশবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে চাননি। নরেশ বালোডিয়া উত্তর দেন, “আমি সংস্থার মালিক নই, আইনজীবী। মালিক সুদীপ্ত সেন আমাকে যে সব কাগজ পাঠাতে বলেছিলেন, তা-ই পাঠিয়েছি। এর বেশি কিছু জানি না।”
তিন দফায় সারদার পাঠানো যে পাহাড়প্রমাণ কাগজপত্র সেবি-র দফতরে এসেছিল, সেগুলির অধিকাংশই ‘ফালতু’, ‘অপ্রয়োজনীয়’ কাগজ বলে দাবি করেছেন সেবির কর্তারা। তাঁদের দাবি, তদন্তকারী অফিসারদের বিভ্রান্ত করতে, তদন্তের কাজে অযথা দেরি করাতে এবং তদন্তের মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই বাজে নথি ঠাসা পেটি পাঠানো হয়েছিল। |