সারদা কাণ্ডের পরে টনক নড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারেরও। ইতিমধ্যেই তারা কর্পোরেট মন্ত্রকের অধীনে একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে এ দিন ঠিক হয়েছে, সেবি-র ক্ষমতা এবং পরিধি বাড়ানো হবে। যাতে চিট ফান্ড-সহ যে কোনও অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তারা কারও নির্দেশ ছাড়াই সরাসরি তদন্ত শুরু করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনও করা হবে।
ঘটনাচক্রে সারদা কাণ্ডের পরে এ দিনই প্রথম মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। রাষ্ট্রপতি ভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “চড়া হারে লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেআইনি ভাবে সাধারণ মানুষের থেকে অর্থ সংগ্রহের কারবার দমন করতে হবে।” সুপ্রিম কোর্টও এ দিন এক নির্দেশিকায় জানিয়েছে, বাজার সংক্রান্ত যাবতীয় লেনদেনের ক্ষেত্রে সেবি-কে আরও কঠোর ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে যাওয়া সেবি-কে সেইটুকুর মধ্যে আর আটকে রাখতে চাইছে না কেন্দ্র। তাদের কাজ ও ক্ষমতার পরিধি এমন ভাবে বাড়ানো হচ্ছে, যাতে যে কোনও অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তারা কারও নির্দেশ বা অনুরোধের অপেক্ষা না করে সরাসরি তদন্ত, তল্লাশি, সম্পত্তি আটক বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
সারদা কাণ্ডের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সেবি বারবার সতর্ক করেছে। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার চিঠি পাঠিয়ে সেবি-কে তদন্ত শুরু করতে বলার পরে তারা সরকারি ভাবে কাজে নামে। একই ভাবে তদন্তের ক্ষেত্রে কোনও সংস্থায় তল্লাশি চালানো, নথিপত্র আটকের ক্ষমতা বা কারও কাছ থেকে তথ্য চাওয়ার অধিকারও নেই তাদের। একমাত্র অভিযোগ এলে তবেই তারা এই ব্যাপারে এগোতে পারে। তাতে সমস্যা হল, সংস্থাগুলি অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়। সারদা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছিল। এ সবের থেকে শিক্ষা নিয়ে সেবি-কে আরও ক্ষমতাবান করতে চাইছে কেন্দ্র।
বস্তুত, কেন্দ্রের বিভিন্ন আইনের মধ্যে যে ফাঁকফোঁকড় ছিল, তা এখন মানছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। তাই ১৯৯২ সালের সেবি আইনে সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। |
নতুন সেবি |
• সরাসরি তল্লাশি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও সম্পত্তি আটক
• অ্যাকাউন্ট, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও ক্ষমতা
• কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার কাছ থেকে সরাসরি তথ্য দাবি
• বাজার থেকে ১০০ কোটির বেশি তুললেই আওতায় |
|
কী সংশোধন হবে সেবি আইনে?
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, কোনও সংস্থা যদি কোনও প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য বহু আমানতকারীদের থেকে টাকা তোলে, তা হলে সেটি ‘কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’-এর আওতায় পড়বে। সেবি-র বর্তমান আইনে এই ‘কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু খুঁত হল, চিট ফান্ডগুলিকে এর বাইরে রাখা হয়েছে। তার জন্য রয়েছে পৃথক চিট ফান্ড আইন। অনেক ক্ষেত্রে ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলি যুক্তি দেয়, তারা যে হেতু শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত নয়, তাই তাদের কাজকর্মে সেবি-র নাক গলানোর অধিকার নেই। ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণের ভার আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাঁধে। কিছু ক্ষেত্রে আবার এই দুইয়ের বাইরে অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে যায় ওই সংস্থাগুলি। আইনের এই জটিলতার ফলে তার ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছিল সংস্থাগুলি। এ বার তাই ঠিক হয়েছে, সমস্ত রকমের চিট ফান্ড, সমবায়, নিধি, অর্থলগ্নি সংস্থা, শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত হওয়া বা না-হওয়া সংস্থা যদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোট ১০০ কোটির বেশি টাকা তোলে, তা হলেই চলে আসবে সেবি-র আওতায়। এ জন্য ‘কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’-এর সংজ্ঞা নতুন করে তৈরি হবে। সেবি-র প্রস্তাব ছিল, ভুঁইফোঁড়দের নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন সংস্থা তৈরি হোক। তার বদলে ঠিক হয়েছে, সেবি-কেই বাড়তি ক্ষমতা দিয়ে তার আওতায় সকলকে নিয়ে আসা হবে।
তা হলে কি সারদা কেলেঙ্কারির ধাক্কাতেই দেরিতে ঘুম ভাঙল কেন্দ্রের?
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা তা মানতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি, গত বছরের জুলাই মাসেই আর্থিক পরিষেবা দফতরের তরফে সমস্ত রাজ্যের মুখ্যসচিবদের চিঠি লিখে তৎপর হতে বলা হয়। ওই চিঠির সারমর্ম ছিল, রাজ্য পুলিশ এবং ইকনমিক অফেন্স উইং যেন সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কোম্পানি নিবন্ধক বা রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ, রাজস্ব দফতর ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ায়। এর পর ফেব্রুয়ারি মাসেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে এ বিষয়ে অনুরোধ করা হয়। সেবি-র আইন সংশোধনের বিষয়েও বেশ কিছু দিন ধরেই চিন্তাভাবনা চলছে। এ বিষয়ে আর্থিক আইন সংস্কার কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলি মেনে আইন পরিবর্তনের জন্য গত বছর জুন মাসে সেবি-র তরফে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। নভেম্বরেও অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে সেবি-র এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন সেই অনুযায়ীই আইনের পরিবর্তন করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি আরও একাধিক তদন্ত শুরু করেছে দিল্লি। এক দিকে কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক গুরুতর তছরুপ তদন্ত শাখা (এসএফআইও)-র অধীনে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স তৈরি করে ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। অন্য দিকে আজ অর্থ মন্ত্রকের তরফে
জানানো হয়েছে, এর পাশাপাশি বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতের চিট ফান্ড ও তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। সুদীপ্ত সেন ও সারদা রিয়েলটি-র বিরুদ্ধে আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও। |