ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা খুলে সাধারণ মানুষের টাকা লোপাট করে দিয়েছেন রানিগঞ্জের এক ব্যবসায়ী। অথচ আমানতকারীরা যখন সেই টাকা ফেরত চাইতে যান, তৃণমূলের এক কাউন্সিলর তাঁকে বাঁচাতে আসেন বলে অভিযোগ। কম হলেও টাকা ফেরত দেওয়া হবে, এই আশা দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই ব্যবসায়ী এখন সপরিবার বেপাত্তা। আমানতকারীরা এক টাকাও ফেরত পাননি। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।
২০১০ সালের ১ নভেম্বর বর্ধমানের রানিগঞ্জে ‘রিয়্যাল ইন্ডিয়া ডেভকন লিমিটেড’ এবং ‘রিয়্যাল ইন্ডিয়া হাইটেক প্রজেক্ট লিমিটেড’ নামে দু’টি সংস্থার অফিস খুলে টাকা তুলতে শুরু করেছিলেন রনাইয়ের বাসিন্দা মঞ্জুর খান। সংস্থার ‘বোর্ড অফ ডিরেক্টরস’-এ নাম ছিল তাঁর ছেলে বাবর খান, তাঁর মেয়ে সাজদা খাতুন, তাঁদের ঘনিষ্ঠ মমতাজ শাহ-সহ আরও কয়েক জনের। তাদের মাসিক আয় প্রকল্পে (এমআইএস) সুদ ছিল ১২ শতাংশ। পাঁচ বছরে স্থায়ী আমানত দ্বিগুণ। রেকারিং এবং দৈনিক প্রকল্পের মাধ্যমেও টাকা নেওয়া হত। এক বছরে ১০ শতাংশ, দু’বছরে ১৪ শতাংশ, তিন বছরে ১৯ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৪৫ শতাংশ সুদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা আর টাকা ফেরাত দিতে পারেনি।
হেনা খাতুন। নিজস্ব চিত্র। |
গত ৩ মার্চ সন্ধ্যা থেকে হাজার খানেক আমানতকারী মঞ্জুর খানের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছন রানিগঞ্জ পুরসভায় তৃণমূলের এক মাত্র কাউন্সিলর, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হেনা খাতুন। পৌঁছয় বিশাল পুলিশ বাহিনী এবং র্যাফ-ও। আমানতকারীদের অভিযোগ, মঞ্জুরকে কার্যত আড়াল করে হেনা খাতুন তাঁদের বলেন, “কম পয়সা হলেও আমরা তা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। প্রয়োজনে মঞ্জুরের বাড়ি, জমি, সম্পত্তি বিক্রি করেও টাকা দেওয়া হবে।” আমানতকারীরা তাতে নিরস্ত হন। পুলিশ মঞ্জুর-সহ কয়েক জনকে থানায় নিয়ে গেলেও কিছু ক্ষণ পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পরের দিন প্রায় আড়াইশো আমানতকারী রানিগঞ্জ থানায় অভিযোগ জানাতে যান। কিন্তু পুলিশ এফআইআর নেয়নি বলে অভিযোগ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে আট লক্ষ টাকা তুলে মঞ্জুরের সংস্থায় এমআইএস-এ পাঁচ লক্ষ এবং পাঁচ বছরের স্থায়ী আমানত হিসাবে তিন লক্ষ টাকা জমা করেছিলেন প্রাক্তন খনিকর্মী আইনুল হক। তাঁর অভিযোগ, “হেনা বলেছিলেন, টাকা ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে। পুলিশও একই আশ্বাস দিয়েছিল। অথচ পরের দিন থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে টাকা জমা দেওয়ার রসিদের প্রতিলিপি জমা দিতে বলে।” এক বছরের প্রকল্পে মহমম্দ আসফাক ৩৬ হাজার, মহম্মদ মক্কিল ২৭ হাজার, মহম্মদ সামশের খান ৩৪ হাজার টাকা ও স্থায়ী আমানতে মুন্না আনসারি ৪০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই একই কথা জানিয়েছেন।
রানিগঞ্জ পুলিশ অবশ্য দাবি করছে, তারা আদৌ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেনি। আমানতকারীরাই বিষয়টি ‘আপসে’ মিটিয়ে নেওয়ার আশায় মামলা দায়ের করেননি। রানিগঞ্জের ওসি উদয় ঘোষের বক্তব্য, “আমানতকারীদের সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ হিসেব করে দেখতেই আমরা রসিদের নকল চেয়েছিলাম।” হিসেবে কী বেরোল? ওসি বলেন, “সব এখনও যোগ করে দেখা হয়নি।”
বেশ কিছুদিন আগেই মঞ্জুর খান বাড়িতে তালা দিয়ে সপরিবার উধাও হয়ে গিয়েছেন। স্থানীয় হাটিয়াতলায় অফিসের যে বোর্ডটি লাগানো ছিল, গত ২০ এপ্রিল সেটিও খুলে নিয়ে গিয়েছে কেউ। ভিক্ষা করে রোজ ১০ টাকা জমা করতেন হেনা পারভিন। তাঁর আক্ষেপ, “প্রায় দশ হাজার টাকা জমা করেছিলাম। সব জলে গেল!” মঞ্জুরের সংস্থার এজেন্ট ওয়াসিম রাজা আনসারির অভিযোগ, “হেনাদি বলেছিলেন, টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু কিছু দিন আগে আমরা তাঁর কাছে গেলে তিনি উল্টে বলেন, ‘শুধু মঞ্জুরেরা পয়সা খায়নি। এজেন্ট হিসেবে তোরাও খেয়েছিস। তোদেরও টাকা ফেরত দিতে হবে।’ মঞ্জুর খানের বাড়িতে বিক্ষোভের সময়ে যে অন্য কথা বলেছিলেন, তা মনে করিয়ে দিলে রেগে গিয়ে তিনি আমাদের তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।”
শুক্রবার হেনা খাতুন অবশ্য দাবি করেন, “এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রশাসনের সাহায্যে সে দিন যা করা উচিত, করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ না করায় পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারছে না।” তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি অপূর্ব মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমার এ ব্যাপারে কিছুই জানা নেই। এখন রাজ্যস্তরে কমিশন গড়া হয়েছে। যাঁর যা অভিযোগ আছে, সেখানেই জানাতে পারেন।” |