|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা ২... |
|
যাত্রার জুটি নম্বর ওয়ান |
অনল চক্রবর্তী-কাকলি চৌধুরী। টানা ষোলো বছর যাত্রামঞ্চে সফল যুগলবন্দি। রহস্য খুঁজলেন সুকান্ত সরকার |
জঙ্গলমহলের লালগড়ে যাত্রা পালা শেষ।
ঘড়িতে প্রায় রাত সাড়ে বারোটা। জয়পুর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছে গাড়ি।
কাজ শুরু করেছিলেন মাত্র পঞ্চাশ টাকা রোজে। তারপর হু হু করে কেটে গিয়েছে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর। নাম হয়েছে। টাকা রোজগার বহু গুণ বেড়েছে। পরের বছর কাজ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হয় না। প্রতি বছরই টাকার অঙ্ক বাড়ে। একাধিক দলের ডাক ফিরিয়ে সব সময় শুধুই দৌড়নো। আজ পুরুলিয়ায় তো কাল হুগলিতে, পরশু উত্তর-চব্বিশ পরগনায় তো তার পর দিন পূর্ব মেদিনীপুরের কোনও গ্রামে। ওঁরা হলেন অনল চক্রবর্তী-কাকলি চৌধুরী। যাত্রার অদ্বিতীয় জুটি। গ্রামবাংলার দর্শক তাঁদের বলেন, যাত্রার উত্তম-সুচিত্রা। স্বপনকুমারী, স্বপ্নাকুমারীর পর অনল-কাকলির মতো এত নামযশ, চিত্পুরের যাত্রা পাড়ায় আর কোনও জুটি পাননি।
যাত্রায় এখন সিনেমা আর সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের রমরমা। তাঁদের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে অনল-কাকলির এই অদ্বিতীয় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা ঠিক কী? কোন মন্ত্রবলে ষোলো বছর ধরে তাঁরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী? কী সেই চুম্বকটান যার জন্য দর্শকেরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন তাঁদের মঞ্চে দেখার জন্য? অনল বলছেন, “আমি আর কাকলি রোজ রীতিমতো অভিনয়ের রেওয়াজ করি। আগের দিনের অভিনয় কাটাছেঁড়া করে পরের দিন নতুন করে একই দৃশ্যে অভিনয় করে চেষ্টা করি ইমপ্রোভাইজেশনের। ষোলো বছর ধরে কাজ করছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাল্টিয়েছি অভিনয়ের ধারা। মানুষ যখন সিরিয়ালে, সিনেমায় চড়া তারের মেলোড্রামা দেখছে না, সেখানে যাত্রায় আমরাও রাখিনি চড়া দাগের অভিনয়। এগুলোই মনে হয় জুটি হিসেবে আমাদের সফল হওয়ার কারণ। আমরা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছি।” |
|
অনল নিজেই গল্প লিখে নাট্যরূপ দেন। তাঁর দাবি, “যাত্রার যে ভাষা সেটাকেও আমি সমসাময়িক করে পরিবেশন করার চেষ্টা করি। মান্ধাতা আমলের যাত্রাপালার স্টাইলে আমাদের যাত্রা হয় না।” এ বছর তাঁদের যাত্রাপালা ‘সেদিন ঠিকানা হারিয়ে’ ১০০ রজনী মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। ২০১২য় ‘একদিন রাত্রে’ ১৪৬ রজনী। ২০১১র পালা ‘প্রেমের ঘাটে নৌকাডুবি’ পার করেছিল ১২৬ রজনী।
প্রতি বছর এই ভাবে শত রজনী পার হয়ে যায় অনল-কাকলির যাত্রা। কী চমত্কারিত্ব আছে এই নায়ক-নায়িকার রসায়নে? উত্তরে কাকলি চৌধুরী বললেন, “আমাদের ইউ এস পি হল স্বাভাবিক অভিনয়। অভিনয় করার সময় বোঝাপড়াটা খুব সূক্ষ্ম তারে বাঁধা থাকে। আর যেটা সব চেয়ে বড় কথা, আমাদের মধ্যে কোনও ইগো প্রবলেম নেই। একশোর জায়গায় দু’শো ভাগ কাজ করি।”
যাত্রা অকাদেমির সম্পাদক কনক ভট্টাচার্যের মতে, জুটির এই দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের কারণ তাঁদের রোমান্টিক অভিনয়। কাকলি পুরুষের মতো অভিনয় করতে পারেন। অভিনয় করলে কণ্ঠস্বর, মডিউলেশন একেবারে বদলে যায়। “সব চেয়ে বড় কথা যাত্রা উপস্থাপনার স্বকীয়তায় ওঁরা গ্রামবাংলার নতুন জেনারেশনকেও ছুঁয়ে ফেলতে পেরেছেন।”
রাতের ঘন অন্ধকারে জঙ্গলের বুক চিরে পিচের রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে ওঁদের গাড়ি। কাকলি বললেন, “মরসুমে আমরা রাত জাগা পাখি। ভোরে সূর্য ওঠার সময় দু’চোখে ঘুম নেমে আসে। ঘণ্টা ৪-৫ ঘুমিয়ে ওঠার পর ফের শুরু করি সেদিনের পালার প্রস্তুতি। ভুলে যাই গত কাল রাতের কথা।”
গভীর রাতে জয়পুর জঙ্গলের বন-বাংলোয় পৌঁছনোর পর একটু ফ্রেশ হয়ে হট-পট খুলে ভাত বের করে আলু-পোস্ত, চুনো মাছের বাটি চচ্চড়ি আর মুরগির ঝোল দিয়ে ‘ডিনার’ সারলেন এই সময়ের যাত্রা জগতের উজ্জ্বল জুটি।
পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর জয়পুরের জঙ্গল থেকে রওনা দেওয়া হল পাত্রসায়রের একটি গ্রামে। |
|
গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে বেজায় বেগ পেতে হল অনল-কাকলিকে। অটোগ্রাফ-শিকারিরা ওঁদের ছেঁকে ধরল। কয়েকটি অটোগ্রাফ কোনও রকমে দিলেনও। উদ্যোক্তারা ভিড়ের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে ওঁদের পৌঁছে দিলেন ব্যাক স্টেজের সাজঘরে।
যাত্রা দেখে আনন্দে উদ্বেল জনতা। কেউ তাঁদের ছুঁতে চায়। কেউ বা চায় অটোগ্রাফ। কেউ বা তাঁদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে দিতে চান বিশেষ সম্মান।
১৯৮৪ সালে যাত্রাপাড়ায় পা রাখা। ১৯৮৬ সালে যাত্রালোক অপেরায় ‘বাগদীপাড়ার বৌ’ পালায় পেচো-র ভূমিকায় অভিনয়ের পরেই অনল যাত্রা জগতের মানুষের নজর কাড়লেন। তার আগে স্নাতক হওয়ার পর সেলস এগজিকিউটিভের চাকরি করেছেন কিছু কাল। স্কুলেও একটা চাকরি পেয়েছিলেন অনল।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে অনলের কাছে যেমন বাবা, কাকলির কাছে একই রকম ভাবে তাঁর মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অভিনয়ে ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান আজও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রেখেছেন কাকলি। বললেন, “ভৈরবমামার কলমের জোরে আমি জনপ্রিয়তা পেয়েছি। আর অনল আমায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করিয়ে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।” অনলের সঙ্গে জুটি বাঁধার আগে একমাত্র ভৈরববাবুর দলেই একটানা সাত বছর অভিনয় করেছেন বলে তিনি জানালেন। কাকলি মনে করেন, “অভাব ছিল বলেই নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছি প্রথম থেকেই। আমার কাছে অর্থ উপার্জনের অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। চিরদিনই অভিনয়কে ভালবেসেছি। আমার মা এবং মামার বাড়ির অনেকেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। আমার এই জায়গায় পৌঁছনোর ক্ষেত্রে যার কথা না বললেই নয় সে আমার স্বামী মৃদুল রক্ষিত।”
কোনও দিনই যাত্রার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না অনল-কাকলি। তাঁরা অভিনয় শেখানোর একটি অবৈতনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিকল্পনা করেছেন।
এই সব কথা যখন যাত্রা ফেরত রাস্তায় অনল- কাকলি বলছেন, তখন ভোর হয়ে আসছে। গঙ্গার পুব পাড়ের আকাশে হালকা লাল রঙের আভার দিকে তাকিয়ে অনল-কাকলি বললেন, “আমাদের এই ষোলো বছরের জার্নিটা খুব উপভোগ করি। তাই, বাকি জীবনটাও যাত্রাকে আঁকড়ে আমরা জুটি বেঁধে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
|
ছবি: দেবরাজ ঘোষ |
|
|
|
|
|