নাটক সমালোচনা ১...
মাত্র পঁচাত্তর পেরিয়ে
র সন্ধের গুমোট গরমে টিমটিম করে জ্বলছে কয়েকটি আলো। তারই নীচে ঘামছেন কলাকুশলীরা। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছোটাছুটি করছেন আর অনর্গল বলে যাচ্ছেন নাটকের ডায়লগ। ফিনফিনে হাফশার্ট, আর প্যান্টের দু’পকেট থেকেই ঝুলছে নাটকের পাণ্ডুুলিপি। তিনি মনোজ মিত্র।
পঁচাত্তরটি বসন্ত কেটে গেলেও পঁচানব্বই বছরের বাঞ্ছারাম কাপালীর নিজের বাগান এখনও আগলে রেখেছেন। একশোরও বেশি নাটক লিখে বা অগুন্তি নাটক ও সিনেমার পর্দায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার পরেও বলতে পারেন, “আমি অভিনেতা। মানুষের মনের কথা বলতে ভয় পাই না।” সেই অভিনয় ফের দেখা যাবে ‘সাজানো বাগান’-এ। সময় বদলেছে, বয়স বেড়েছে কিন্তু এই নাটকের বাঞ্ছারাম কাপালীর যেন পরিবর্তন হয়নি। এই সেই বাঞ্ছারাম কাপালী যিনি আবারও মঞ্চে একই চরিত্রে অভিনয় করবেন। নিজের বাগান অর্থে ভিটে আগলানোর লড়াই জমিদার নকড়ি-ছকড়ি দত্তদের স্বার্থান্বেষী চক্রান্তের বিরুদ্ধে। হাসির আড়ালেই ফুটে ওঠে সমাজচেতনার মূল সুর। আবারও শোনা যাবে এক সময়ে মঞ্চ উত্তাল করা সেই সব ডায়লগ। ‘আমি এখন কী করি? এ বেটার বগলে বউ, এ বেটার বগলে নাইরকোল, আমি কোন দিকে যাই?’ ‘চির দিন আমরা খেটে খেয়েছি, পরের মেরে তো খাই নাই, ওটা আপনাদেরই দস্তুর, আজ বসে বসে আপনার টাকা খেয়ে, আপনার কাছে টাকা নিতে আমার বড্ড লজ্জা করে। টাকাটা দেবেন কত্তা?’
এখনও এই বয়সেও তাঁর শিল্পীসত্তাকে শ্রদ্ধা করতে কার্পণ্য করলেন না কৌশিক সেন। সেই কবে ২৯ মে ১৯৯২-তে স্বপ্নসন্ধানীর প্রথম নাটক মনোজ মিত্রের ‘আঁখিপল্লব’ কী ভাবে দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছিল তা এখনও মনে আছে কৌশিকের। “সত্যি কথা বলছি, ওঁর একের পর এক নাটক দেখে আমি এখনও ওঁকে অন্য চোখে দেখি। ‘যা নেই ভারতে’ দেখে আসার পর মনে হয়েছিল এমন নাট্য ব্যক্তিত্বকে এখনও কেন মানুষ এত ভালবাসেন,” বললেন কৌশিক। এমন নাট্যকার ও অভিনেতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত তাঁর মনের গোপন ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিলেন। “আমার ধারণা মনোজ আরও ১৫ থেকে ২০ বছর বাঁচবেন শুধু নাটকের জন্য। ওঁর বয়স যখন ৯৫ হবে তখন এর চেয়েও জমকালো নাট্যোত্‌সব হবে এই কলকাতাতেই,” আশাবাদী রুদ্রপ্রসাদ।
‘সুন্দরম’এর নাটক রেওয়াজের ফাঁকে এ সব কথা শুনে তিনি সত্যিই হেসে ফেললেন। “ঝড়, দুঃখ আর দুর্দশা দিয়েই জীবনের শুরু। কী পেলাম বা কী পাইনি তা কখনও ভাবিনি। কিন্তু যখন দেখি আমার নাটক, আমার অভিনয় এত মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে তখন মনে হয় আমার পথ চলা সফল কিন্তু পৌঁছতে আরও বাকি।”
কী বাকি কতটা বাকি তিনি নিজেও তা জানেন না। তবে সময় পেলেই পিছন ফিরে তাকান কখনও কখনও। যেমন ‘পরবাস’। দারুণ সেই গল্প। মনোজের কথায়, “অনেক দিনের কথা। তবুও কেন জানি না ভুলতে পারি না।” কেন? “দর্শকদের ভালবাসা পাওয়া সেই যে শুরু।” কী ছিল সেই নাটকে? মামলায় হেরে উচ্ছেদের মুখোমুখি নিঃসঙ্গ গজমাধবরূপী মনোজ, তার বসবাসের চিলেকোঠা, মামলা জিতে উচ্ছ্বসিত বাড়িওয়ালা আর ঘরভাড়া নিতে আসা নবদম্পতি এই কুশীলব ঘিরে হাসির মোড়কে ফুটে ওঠে জীবন বেদনা। সামান্য চাকুরে গজমাধবের বিয়ের বাসনা পূর্ণ হয়নি। বাড়িওলা করালীর বাবার আমল থেকে করালীর বর্তমান আমল পর্যন্ত ভাড়াটে হয়ে থেকে যান বিবাহিতের ছদ্ম-পরিচয়ে। শীঘ্রই দেশ থেকে আনবেন স্ত্রীকে এই স্তোকবাক্যে। মামলায় হারা নায়কের বিদায়লগ্নে ওই ঘরের মালিকানা পাবে মন্দিরা। সেও কুমারী। সঙ্গে স্বামীর পরিচয়ে আসে অবিবাহিত প্রেমিক রতন। আপাতদৃষ্টিতে গজমাধব আর মন্দিরা দু’জনেই অবিবাহিত। জানা যায়, দু’জনেরই সাতকুলে কেউ নেই। মিথ্যের আশ্রয়ে ঘর আঁকড়াতে চায় দুই অসমবয়সি অচেনা মানুষ।
অবশ্য তার আগে সবটাই সুখের ছিল না। ১৯৫৭ সালের ১৫ অগস্ট কলেজ পেরোনো কয়েক বন্ধু মিলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘সুন্দরম’ নাট্যদল। কিন্তু শিক্ষকতার কাজে যোগ দেওয়াতে বন্ধ করতে হয়েছিল তাঁর নিয়মিত অভিনয়। “কিন্তু এমনটা তো চাইনি। তাই ফের ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই নাটক নিয়েই।”
বয়স ধরে রাখতে তিনি এখনও প্রচুর পরিশ্রম করেন। খাওয়া-দাওয়ারও অনিয়ম করেন না। নাটকের বাইরে আর কোনও বাড়তি চিন্তা বা টেনশন রাখেন না। এটাই কি সাফল্যের বড় টিপস? “না। সাফল্যের জন্য প্রয়োজন মনের ইচ্ছা। যেটা আমার আছে এবং সেটাই প্রেরণা দেয়।” সেই কবে জরুরি অবস্থার আদেশে দেশ উত্তাল হয়েছিল। মনোজ নির্ভয়ে করেছিলেন ‘নরক গুলজার’। ব্যঙ্গ-বাণে মুখে মুখে ফিরে এসেছিল সেই গান ‘কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না/ ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন/ গোলযোগ সইতে পারে না’। “আমি অভিনেতা। মানুষের মনের কথা বলতে ভয় পাই না।” এখনও টানটান মনোজ।
আর তাই এখনও তিনি থিয়েটারের ভিন্ন সূত্র, ভিন্ন সত্তা। ‘মেষ ও রাক্ষস’, ‘নৈশভোজ’, ‘রাজদর্শন’, ‘দম্পতি’, ‘কিনু কাহারের থেটার’, ‘দর্পণে শরত্‌শশী’, ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’-এর মতো বহু নাট্যের আগল ছেড়ে ভিন্ন মানবিকতার রচনায় মনোজ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠেন ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘গল্প হেকিমসাহেব’, ‘শোভাযাত্রা’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, ‘রঙের হাট’ নাটকে। বিতর্ক হবে জেনেও তিনি মহাভারতের বিভিন্ন আখ্যানকে মেলে ধরেছিলেন বর্তমানের পাদপ্রদীপে। পাণ্ডব নিধনে কৃতসঙ্কল্প অশ্বত্থামা হত্যা করলেন কয়েকটি শিশুসন্তান। তাঁর সঙ্কল্প-বীরত্ব-সৈন্যাপত্যের কর্তব্য সবই ব্যর্থ হল। মহাবলীর মহাপরাজয়কে ঘিরে মনোজ প্রায় তিন যুগ আগে লিখেছিলেন ‘অশ্বত্থামা’। সেই সংকটই যেন নতুন চেহারা নেয় মনোজের মহাভারত-ঘেরা আপাত বর্তমান ‘যা নেই ভারতে’ নাটকে। সমকালীন আর্তি হয়ে ওঠে গান্ধারী-ধৃতরাষ্ট্রের অক্ষম অনুশোচনা: ‘পুত্রগণ, আমরা বড় অসহায়, বড় একা, নিরাপত্তা বিলীন। ওই দেবতা-সাধু আর যোদ্ধাদের মিলিত চক্র আমার ধ্বংসে এগিয়ে আসে’।
অনেকেই বলেন মনোজ মিত্র ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্ব, যিনি নাটক নিয়ে নিজের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সত্যিই কি তাই?
মনোজের কথায়, ‘‘থিয়েটার তো নৃত্য-গীত-ভাস্কর্য- চিত্রকলা থেকে কত সূত্র নিয়েছে। নিয়েছে এবং আত্মসাত্‌ করেছে। এটা করতে পারে বলেই থিয়েটারের ভাষা কখনও পুরোনো হয় না। থিয়েটার কালে কালে বিবর্তিত হয়, নতুন চেহারায় দেখা যায়। তেমনই পরিবর্তন ঘটে আমার নাটকেও।”
কথা শেষ হতে না হতেই তিনি আবারও নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে চলে গেলেন কলাকুশলীদের শেষ সংলাপটি বোঝাতে। তিনিই যে বড় কান্ডারি। কাল থেকে যে ৬ দিনের নাট্যোত্‌সব শুরু।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.