|
|
|
|
|
|
সেই সাপ জ্যান্ত |
সাপ মারা একটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ।
সব সাপই
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন ১৯৭২ দ্বারা
সংরক্ষিত।
লিখছেন কৌশিক |
যে কোনও সাপ দেখলেই মানুষ বিপন্ন বোধ করে, ভয় পায়। এতটাই ভয় যে, সন্ধে পেরোলেই তার নাম হয়ে যায় ‘লতা’। সাপ মানে একটা গা ঘিনঘিনে বিষাক্ত প্রাণী, অতি বিপজ্জনক, অতি ভয়ানক। এই কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে সাপ দেখা দিলে সে সাপটিকে উইকেট দিয়ে পিটিয়ে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিল। ওর স্ত্রী ভয়ে অস্থির হয়ে ঘরের বেলুন, হাতা এমনকী কড়াই নিয়ে সাপটির উপর চড়াও। অবশেষে কার্বলিক অ্যাসিড ঢেলে, পুড়িয়ে দেওয়া হল সাপটিকে। বন্ধুর ঘরে দুই মেয়ে রয়েছে, প্রাণে বাঁচতে এটা ওকে করতেই হল।
সে দিন পাড়ার আড্ডায় সাপের কথা উঠতেই সবার মুখে একটাই কথা, কোথাও সাপ দেখলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা মানে নিজেদের বিপদে রাখা। সত্যিই তো, আপনার আমার স্ত্রী-সন্তানদের জীবন যখন এই প্রাণীটির দ্বারা বিপন্ন, তখন সবার আগে একটা কাজই শ্রেয় বলে মনে হয় সাপ দেখলেই মেরে ফেলা। |
|
বঙ্কোরাজ |
এ বার একটু অন্য কথায় আসা যাক। টিকটিকি, ব্যাঙ, পোকামাকড় ছাড়াও সাপেদের খাদ্যের মূল অংশ হল ইঁদুর প্রজাতির প্রাণীরা। এই ইঁদুর যে ভয়ানক ক্ষতিকারক মানুষের জন্য, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ভারতের ১/৫ ভাগ খাদ্যশস্যের ধ্বংস করে ইঁদুর। বেশ কিছু অসুখ আছে যা ইঁদুর বা ওই জাতীয় প্রাণীর দ্বারা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং মারাত্মক আকার ধারণ করে। সেলমোনেলেসিস নামক এক ধরনের খাদ্য বিষক্রিয়া ঘটে এই ইঁদুরের দ্বারা যা আমাদের পেটের উপর (বিশেষ করে কিডনি) আঘাত হানে। যে সব ইঁদুর আমাদের বাড়িতে ঘোরাফেরা করে তাদের শরীরে এক ধরনের পরজীবী বাস করে, যা মানুষকে কামড়ালে রিকেটসিয়ালপক্স নামক অসুখ হতে পারে। (উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, এই রোগের ব্যাকটিরিয়া বাস করে ইঁদুরের শরীরে, ইঁদুর থেকে ওই পরজীবীর শরীরে এবং সেখান থেকে মানুষের শরীরে আসে)।
শুধু তাই নয়, এই প্রাণীদের থেকে জ্বর, চুলকানি, মাংসপেশির ব্যথা এমনকী শরীর পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। আমরা নিজেদের বাসস্থান যত সাজিয়েগুছিয়ে সুন্দর করে তুলছি, ততই পক্ষান্তরে ইঁদুরের বাড়বৃদ্ধির সুবিধা হচ্ছে। যে এলাকায় মাটি বলতে শুধুই কংক্রিট, সাপেরা সেই স্থান ত্যাগ করে আর সেখানে ইঁদুরেরা খুব সহজেই জীবনযাপন এবং বংশবৃদ্ধি করে। ইঁদুর-প্রজাতির প্রাণীরা যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে অত্যন্ত পারদর্শী। |
|
|
কেউটে |
গোখরো |
|
একটি স্ত্রী ইঁদুর প্রত্যেক ২১ দিন অন্তর এক বারে ১০টি বাচ্চা প্রসব করে। অর্থাৎ বছরে কম করে এরা ১০ থেকে ১২ বার বাচ্চার জন্ম দেয়। এই বাচ্চারা আবার ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। যদি এই বাচ্চাদের অর্ধেকও স্ত্রী হয় এবং এরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয় তা হলে দেখা গেছে যে এক জোড়া ইঁদুর এবং তাদের শাবকরা বছরে ২০০০টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে।
এ ছাড়া যে সব প্রাণী সাপ শিকার করে (যেমন শিকারি পাখি, বেজি ইত্যাদি), সাপের সংখ্যা মাত্রাছাড়া ভাবে কমতে থাকলে খাদ্যসংকটে পড়বে তারাও। ফলে জীববৈচিত্র্যে অনেক পরিবর্তন আসবে যা পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে, আর সেই ক্ষতির ফল অবশ্যই মানুষকেও ভোগ করতে হবে। অতএব অকারণে সাপ হত্যা করা মানে হল বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে নিজেদের বিপর্যয় ডেকে আনা। পৃথিবীতে বাস্তুচক্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিটি জীবের অস্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে ১৩.৫ কোটি বছর আগে সাপের আবির্ভাব। বর্তমানে অবাধ নগরায়নের ফলে এখন সাপের বাস্তুভিটে সংকটে। সাপের বসবাসের গর্তগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সাপকে বাসা খুঁজতে হচ্ছে অন্যত্র। আর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারলে দেখা দিচ্ছে অস্তিত্বের সংকট। ঝোপজঙ্গল, গাছপালা কেটে ফেলায় বেড়ে যাচ্ছে মাটির তাপমাত্রা যা আরও প্রতিকূলতা তৈরি করছে সাপের টিকে থাকার জন্য। আধুনিক কৃষিপদ্ধতিতে কৃষকেরা যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন, তাও সাপের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ছাড়া অকারণ আতঙ্কে নির্বিচারে নির্বিষ সাপ হত্যা করার ঘটনা তো ঘটছেই। কিন্তু সাপের সংখ্যা কমে যাওয়া যে আদৌ কোনও মঙ্গলজনক ঘটনা নয়, তা বোঝা যায় উপরের তথ্যগুলি থেকে। |
|
বেতআছড়া |
কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরাসরি মানুষের উপকারে আসে সরীসৃপ গোত্রের এই প্রাণীটি। যে এভিএস (অ্যান্টি স্নেক ভেনম সেরাম) সাপের কামড়ে আক্রান্ত মানুষের প্রাণ বাঁচাতে তৎপর, সেটি এই সাপের বিষ থেকেই তৈরি হয়। বর্তমান চিকিৎসাশাস্ত্রে হৃদরোগ বা ক্যানসার জাতীয় জটিল রোগের নিরাময়ের জন্য সাপের বিষ ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমার বন্ধু যে সাপটিকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করল সেটি আসলে ছিল একটি জলঢোড়া, অতি নিরীহ একটি সাপ। এ ভাবেই মানুষের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে সর্বদাই ভীতিপ্রদ এবং শত্রুতাপূর্ণ, আর মানুষের হাতে সাপের জীবন সংশয় হয়ে উঠেছে অতি সাধারণ, স্বাভাবিক ও নিশ্চিত ঘটনা। কিন্তু সাপ মারা একটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ। সব সাপই বন্যপ্রাণ (সংরক্ষণ) আইন ১৯৭২ দ্বারা সংরক্ষিত। সব থেকে বড় কথা হল, পরিবেশের সুস্থতা বজায় রাখতে গেলে সাপকেও বাঁচতে দিতে হবে। সাপ মাত্রেই বিষধর নয় এবং মানুষের শত্রু নয় এ কথা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে এবং আগামী প্রজন্মের মনেও যাতে সাপ সম্পর্কে অহেতুক কুসংস্কার না জন্মায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। |
|
|
|
|
|