ইডেনের হাজারো ওয়াটের সাউন্ড সিস্টেমে যখন গমগম করছে সাচ্চা মর্দ হয়ে ওঠার মন্ত্র। গ্যালারিতে আট থেকে আশি, সবাই যখন নাকের নিচে স্বাস্থ্যবান গোঁফ লাগিয়ে মর্দ হয়ে ওঠার চেষ্টায়, নাইটদের ড্রেসিংরুমে তখন অন্য এক মন্ত্র। পেপসি আইপিএল সিক্সে নিজেদের অকালমৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার মন্ত্র। সে-ও তো মর্দ হয়ে ওঠারই মন্ত্র।
চেন্নাই থেকে কোনও এসএমএস বা ফোন উড়ে এসেছে কিনা জানা নেই। এসআরকে নামক কোনও অক্সিজেনের জোগান হয়তো পাননি গৌতম গম্ভীররা। তাতে কী? নাইটরা নিজেদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করে নিলেন নিজেরাই। একটা সিলিন্ডারের নাম মনবিন্দর সিংহ বিসলা। অন্য সিলিন্ডারটার নাম ওয়েন মর্গ্যান। তাঁদের ৪৪ বলে ৭২ রানের জুগলবন্দিই ফের ভাসিয়ে তুলল প্রায় ডুবে যাওয়া নাইটদের জাহাজকে। কিংসদের বিরুদ্ধে ছ’উইকেটে জয় গত বারের চ্যাম্পিয়নদের বার করে আনল আইসিইউ থেকে। যে লড়াই শুরু করেছিলেন আহত বাঘ কালিস, সেই লড়াই থেকে উত্তাপ নিলেন ঘা খাওয়া বিসলা আর তাতে তাতলেন দুঃসাহসী ওয়েন মর্গ্যান। ফারহান আখতার-শানের মর্দ মন্ত্রে যেন দীক্ষিত হয়ে উঠলেন কেকেআরের তিন দেশি-বিদেশি ক্রিকেটার। পঞ্জাব পুত্তরদের হারাতে কে হয়ে উঠবেন আসল মর্দ তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল ইডেনে। |
বিসলার ৪৪ বলে ৫১-এ তিনটে করে ছয় ও চার। মর্গ্যানের ২৬ বলে ৪২-এ চারটে ছয় ও তিনটে চার। তার আগে কালিসের ৩৩ বলে ৩৭। এতেই যখন কেল্লা ফতে হল, তখনও দশ বল দেখার বাকি ইডেনের দর্শকদের।
ব্যাটে-বলে যখন পুরুষ সিংহ তিন টিমমেট, তখন পৌরুষে গরজাচ্ছেন তাঁদের ক্যাপ্টেন। কিংস ব্যাটসম্যানদের হাতে শেষ ওভারে বেধড়ক ঠ্যাঙানির খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বালাজির ভাগ্যে জুটল আর এক বিড়ম্বনাওগম্ভীরের রক্তচক্ষু ও মাঠেই প্রকাশ্য বিষভাষণ। খেলার পর গম্ভীর যখন বলছেন, “ও সব মাঝেমাঝে না করলে হয়? যেমন বলেছিলাম, তেমন বল করতেই পারছিল না বালা। সে জন্যই তো মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।” তখন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে মিচকে হাসি হাসছিলেন তামিল পেসার। তিনি, সুনীল নারিন ও সচিত্র সেনানায়েকে এ দিন দলের জন্য তেমন কিছু করতে পারলেন না যে। বরং কালিস বল হাতেও অনেক বেশি চনমনে, সফল। |
কালিসের চোটটা যে ততটা গুরুতর নয়, তার খবর আগের রাতেই নাইট শিবির থেকে পাওয়া যায়। ম্যাচ শুরুর ২২ ঘন্টা আগে ব্রেন্ডন ম্যাকালামকে ফের একবার হতাশায় ডুবিয়ে দিয়ে কালিস নিজেই যখন জানিয়ে দেন, তিনি শুক্রবারও মাঠে নামার জন্য তৈরি, তখন দলের অনেকেই হয়তো ‘আবার!’ বলে স্বগতোক্তি করেছিলেন। কিন্তু এ দিন যা আধিপত্য দেখালেন উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচের অন্যতম। যে ভাবে শুরুতেই গম্ভীর, ইউসুফদের ফিরে যাওয়ার ধাক্কা সামলালেন ব্যাট হাতে। এই ধরনের ম্যাচে ঠিক কী রকম বোলিং বিশ্লেষণ হওয়া উচিত তা শেখালেন বিশেষজ্ঞ বোলারদের, এর পর তাঁকে নিয়ে দলের মধ্যে আর বাইরেও গুঞ্জন কমতে বাধ্য।
৪ ওভারে দিলেন মাত্র ১৪ রান। মনদীপ সিংহ ও ডেভিড হাসি কিংস ব্যাটিং লাইন আপের দুই স্তম্ভকে মাথা নত করতে বাধ্য করেন কালিস। ফুঁসতে থাকা আজহার মেহমুদকে দমানোর চেষ্টাও করলেন নিজস্ব স্টাইলে হাফ ডজন বাউন্ডারি হাঁকিয়ে। দেশের বর্তমান নারী নিগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তরুণ প্রজন্মকে সত্যিকারের মর্দ হয়ে ওঠার মন্ত্র শোনালেন এ দিন ইডেনে ম্যাচের আগের ফারহান-শান জুটি। লক্ষ্য একসঙ্গে বড় অডিয়েন্সকে ধরা। বাইশ গজে তেমনই ব্যাটে-বলে মর্দ হয়ে উঠে চলতি আইপিএলে কেকেআর-নিগ্রহ আটকালেন কালিস। অক্ষুন্ন থাকল নাইট-বাহিনীর সম্মান। |
কালিসের মর্দ মন্ত্রে এর পর লড়াই শুরু মর্গ্যান ও বিসলার। আইসিইউ থেকে বেরনোর জন্য কতটা মরিয়া তাঁরা তা এই দুই নাইটের যুদ্ধ দেখেও বোঝা গেল। হরমিতের এক ওভারে ১১ ও পরের ওভারেই আজহারকে একটা ছয় ও একটা চার মেরে ১৪ নেওয়াটা সেই যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসের অক্সিজেন জোগানোর পক্ষে যথেষ্ট। শুরুতেই বিসলা যে ভাবে মনদীপ সিংহের হাতে সহজতম ক্যাচ দিয়েও প্রাণ পেয়ে যান। পরের বলেই আজহারের ইনসুইঙ্গার যে ভাবে গম্ভীরের স্টাম্প ছিটকে দেয়। তার পরের বলেই যে ভাবে ইউসুফ পাঠানও গিলক্রিস্টের গ্লাভসে বল গুঁজে দিয়ে ডাগআউটের দিকে হাঁটা লাগান, তাতে ২০১২-র চ্যাম্পিয়নদের ২০১৩-এ অকালমৃত্যুর বর্ণনা প্রায় লেখা শুরুই হতে যাচ্ছিল প্রেসবক্সের ল্যাপটপগুলোতে। আর তখনই সব হিসেব পালটে দিয়ে জেহাদ ঘোষণা শুরু কালিস-বিসলা-মর্গ্যানদের। মর্দ হয়ে ওঠা নাইটদের। গোঁফ না থাকুক, যাদের কিন্তু স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে!
|