চ্যানেল ও খবরের কাগজ খোলার আগেই কলকাতার ফুটবল ক্লাবগুলিকে ‘স্পনসর’ করতে শুরু করেছিলেন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন।
সেবির নজরে থাকা বেশ কিছু ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাই নিজেদের প্রচারের স্বার্থে কলকাতা ময়দানের বহু ক্লাবকে টাকা দেয়। ২০০৭-০৮ সালেই এই ভাবে ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়ার কাজটা শুরু করেছিল সারদা। প্রথমে ময়দানের সুপার ডিভিসনের ক্লাব কালীঘাট, তার পরে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এবং টুটু বসু-সৃঞ্জয় বসুদের পারিবারিক ক্লাব ভবানীপুরে। কালীঘাটে কুড়ি লাখ দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অন্তত চল্লিশ কোটি টাকা স্পনসর হিসাবে ক্লাবগুলির পিছনে সুদীপ্ত খরচ করেছেন বলে খবর।
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা ময়দানে টাকা ঢালে প্রচারের জন্য বিষয়টি নতুন নয়। কিন্তু ক্লাবগুলিকে সামনে রেখে ময়দানের কর্তারা নিজেদের ব্যবসা বা আখের গোছান, এই অভিযোগ ফের মাথাচাড়া দিয়েছে সিবিআইকে পাঠানো সুদীপ্ত সেনের চিঠিতে। ইস্টবেঙ্গলের কার্যকরী কমিটির সদস্য তথা প্রভাবশালী কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুর বিরুদ্ধে সুদীপ্ত যে অভিযোগ এনেছেন, তা যথেষ্ট গুরুতর বলেই মনে করছে ময়দান। এবং আপাত শান্ত ময়দান এখন এই অভিযোগ ঘিরেই সরগরম।
দেবব্রত সরকার |
চিঠিতে সুদীপ্তর অভিযোগ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি তথা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং সেবির চেয়ারম্যান ইউ কে সিংহের নাম করে দেবব্রতবাবু এবং আরও কয়েক জন তাঁর কাছ থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকা নিয়েছেন। চিঠির ১৫ নম্বর পাতায় সুদীপ্তর অভিযোগ, “ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ‘ডি-ফ্যাক্টো’ সচিব দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু এক দিন আমাকে আশ্বাস দেন যে, সেবির তৎকালীন চেয়ারম্যান ইউ কে সিংহ এবং আরও বড় কর্তাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। ওঁদের সাহায্যে তিনি বিষয়টি মিটিয়ে দেবেন।” সুদীপ্তর দাবি, দেবব্রতবাবু তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকারী সজন অগ্রবাল এবং তাঁর পুত্র সন্দীপ অগ্রবাল রাষ্ট্রপতির খুব কাছের। দেবব্রতবাবুর আশ্বাস ছিল, ওঁর চাহিদা মতো টাকা দিয়ে দিলে বিষয়টি মেটানো যাবে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এই বাবদ প্রথমে আমি পাঁচ কোটি টাকা দিয়েছি। তার পর প্রতি মাসে ৮০ লক্ষ টাকা দিতে হত। বেশির ভাগ টাকাই দিতে হত নগদে। কিছু চেকও দিয়েছি। সেগুলো দিতে হত রেভলন কোম্পানির নামে। আমার অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে এ ব্যাপারে সব কাগজপত্র আছে।”
সুদীপ্ত চিঠিতে আরও জানিয়েছেন, “ওই সংস্থাটির সঙ্গে আমাদের কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই কিন্তু নিতুর বিবৃতি অনুযায়ী, তারা চেক প্রতি যা ভ্যাট হয়, সেই টাকাটা নিয়েছে। যদিও চেকে দেওয়া অর্থের পরিমাণ খুবই কম। মোট অঙ্কের ৫ শতাংশও নয়। বাকি নগদ টাকা সব সময়েই আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি বাড়ির তিন তলায় অথবা কখনও সরাসরি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে পৌঁছে গিয়েছে।”
ক্লাবের অন্যতম কর্তার নামে এই অভিযোগ ওঠার পর বৃহস্পতিবার নজিরবিহীন ভাবে তড়িঘড়ি ক্লাব তাঁবুতে কর্মসমিতির সভা ডাকা হয়। সভার শেষে ক্লাব সচিব কল্যাণ মজুমদার এবং সহ-সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “দেবব্রত ক্লাবের জন্য টাকা এনেছেন। তা ক্লাবের অ্যাকাউন্টসে দেখানো হয়েছে। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা দেবব্রতর পাশে আছি।” কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ভবানীপুর, মোহনবাগান বা কালীঘাট ক্লাব সারদার স্পনসরশিপের টাকা নিলেও তারা কোনও সভা ডাকেনি। তা হলে লাল-হলুদে সভা কেন?
ইস্টবেঙ্গলকে যে স্পসনরশিপ ও গ্যালারি সংস্কারের জন্য পাঁচ কোটি এবং পরে এক কোটি টাকা দিয়েছেন, তা-ও চিঠিতে জানিয়েছেন সুদীপ্ত। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “নগদে এবং চেকে পাঁচ কোটির টাকা দিয়েছি। পরে এক কোটি টাকা দিয়েছি গ্যালারি সংস্কারের জন্য। এক কোটি টাকার চেক এখনও নিতুর কাছে আছে। সেটা ফেলতে নিষেধ করেছি।” কিন্তু ক্লাবের জন্য দেওয়া সব টাকা কি জমা পড়েছে তহবিলে? চেকের টাকা জমা পড়লেও নগদ টাকা পুরো জমা পড়েনি বলে অভিযোগ। ক্লাব সূত্রের খবর, সুদীপ্ত যে পরিমাণ টাকা দেওয়ার
কথা বলছেন, তা ক্লাবের অ্যাকাউন্টসে দেখানো নেই। শোনা যাচ্ছে,
পাঁচ কোটি টাকার মধ্যে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার মতো জমা পড়েছে
ক্লাব তহবিলে।
ক্লাবকে দেওয়া টাকা ছাড়াও নিতু, সজন ও সন্দীপদের বিরুদ্ধে যে বিপুল পরিমাণ টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন সারদা-কর্তা, তা নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের সচিব-সহ-সচিব কোনও উত্তর দিতে চাননি। তাঁরা শুধু বলেছেন, “সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
চিঠিতে সারদা-কর্তার আরও অভিযোগ, “আমাকে সব সময় ভয় দেখানো হত। টাকা দিতে দেরি করলে বলা হত, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক এনে ঝামেলা করা হবে।”
চিঠিতে মুম্বই নিবাসী এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ তুলেছেন সুদীপ্ত, যাঁকে বলা হয়েছে দেবব্রতবাবুর আত্মীয়। তাঁকেও ব্যবসায় টাকা দিয়েছেন দাবি করে সুদীপ্ত লিখেছেন, “মিস্টার ঘোষ নামে নিজের মোবাইল থেকে এক জনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিত নিতু। তাঁকে আমি কখনও দেখিনি। তিনিই মিস্টার যশের ব্যাপারটা দেখতেন।” মিস্টার ঘোষ কে, তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে মুম্বই নিবাসী যে ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, সুদীপ্তর চিঠিতে তাঁর নামের বানানে কিছু ভুল আছে বলে মনে করছে ময়দান। চিঠির বিবরণ অনুযায়ী, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এক প্রয়াত কর্তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে ওই ব্যক্তির মিল রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। ওই ব্যক্তি সম্প্রতি মুম্বইয়ের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে আন্ধেরিতে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে ময়দান সূত্রের খবর।
সারদা-কর্তার অভিযোগ প্রসঙ্গে কী বলছেন দেবব্রতবাবু?
শুক্রবার তিনি বলেন, “আমি চাই সিবিআই বা সরকার উপযুক্ত তদন্ত করে দেখুক। উপযুক্ত লোককে শাস্তি দিক। যদি প্রমাণ হয়, তা হলে আমরাও শাস্তি পাব।” |