|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ৩... |
|
ললিতাকে আজ চলে যেতে বোলো না |
ষাটের দশকে উত্তমকুমারের নায়িকা। আজ জীবিকার টানে স্পোকেন
ইংলিশের ছাত্র খোঁজেন। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় |
গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অঙ্ক’ করার পর ভেবেছিলাম অবস্থাটা বদলাবে। কিছু অন্তত কাজ আসবে। এত লোকে ফোন করলেন, এত প্রশংসা পেলাম...। কিন্তু কোথায় কী! আবার যে কে সেই। কোনও কাজ নেই।”
দেশপ্রিয় পার্কের কাছে তাঁর তিন তলার ফ্ল্যাটে বসে বলছিলেন ললিতা চট্টোপাধ্যায়। ‘শূন্য অঙ্ক’-র লায়লা। ষাটের দশকের মাঝামাঝি যাঁর ফিল্মি জীবন শুরু হয় উত্তমকুমারের নায়িকা হিসেবে। মুম্বইতে এক সময় যাঁর সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীর মধ্যে ছিলেন অশোককুমার, সঞ্জীবকুমার, রাজেশ খন্না, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, শর্মিলা ঠাকুর....।
কাজ নেই, তাই এক রকম বাধ্য হয়েই আবার টিউশনির জীবনে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। স্পোকেন ইংলিশের ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে যা আসে, আসে। অল্প কিছু জমানো টাকা, সরকারি একটা পেনশন। তাতে কোনও ক্রমে চালিয়ে নিচ্ছেন একার সংসার।
“কিন্তু এখনও যে অভিনয়টা আমায় টানে! খুব ইচ্ছে হয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণ (ঘোষ) বা সৃজিতের (মুখোপাধ্যায়) মতো কারও সঙ্গে কাজ করার! ওঁরা ডাকেন না, আর আমিও অভিনয় করতে চাওয়ার ব্যাপারে চিরকালই মুখচোরা,” বলছিলেন ললিতা।
বয়স সত্তর পেরিয়েছে, কিন্তু চলাফেরায় এখনও চনমনে। রোজ সকালে হাঁটতে বেরোন। ফিরে এসে যোগাসন। বাড়ির কাজকর্ম অনেকটাই নিজের হাতে।
“বলতে নেই, এখনও শরীরটা তেমন ভোগায় না। কিন্তু মাঝে মাঝে ভয় লাগে অন্য জায়গায়। বাড়িটা তো নিজের নয়। ভাড়ার। ছেচল্লিশ বছর ধরে এখানেই আছি। এখন বাড়িওয়ালা ছেলেটি আমায় উঠিয়ে দিতে চাইছে। অথচ ছেলেটিকে একদিন আমি কোলেপিঠে মানুষ করেছি, জানেন! সে-ই এখন মামলা করেছে। যদি হেরে যাই, জানি না, কোথায় গিয়ে দাঁড়াব!” বলছিলেন ললিতা।
বিপাকে পড়েছেন ঠিকই। তবে কারও করুণা চান না তিনি। নিজেকে অসহায় ভাবতেও বাধে। সোজাসাপটা বলে দেন, “বিদেশে দেখেছি, এমন অবস্থায় সরকারই সব দায়-দায়িত্ব নেন। এখানেও তো কিছু কিছু তেমন হয়েছে। ওটুকু পেলেই...।”
মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে এক সময় প্রাক্তন আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে গিয়েছেন। তখন বাম সরকার ক্ষমতায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর কাছেও ছুটেছেন। আশ্বাস পেয়েছেন, কিন্তু এখনও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। |
|
উত্তমকুমার, ললিতা চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়াদেবী |
চার বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে একে একে চলে গিয়েছেন প্রায় সকলে। এক দিদিই যা বেঁচে। যোধপুর পার্কে থাকেন।
বছর কয়েক আগে এক দাদার মৃত্যু আজও কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না ললিতা! “দাদা, বৌদি ওঁদের মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন দার্জিলিং। পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় রাস্তাতেই দাদা, মেয়ে শেষ হয়ে গেল। কোনও ক্রমে রক্ষা পায় বৌদি,” দু’আঙুলে চোখ দুটো টিপে ধরেন ললিতা।
ললিতাদেবী প্রথম বার বিয়ে করার পর বিবাহবিচ্ছিন্না হন। পরে আবার বিয়ে করেন। সে বিয়েও টেকেনি। কিন্তু যোগাযোগটা ছিল দু’জনের সঙ্গেই। এখন তাঁদেরও কেউ আর নেই।
“বছর চোদ্দো আগে আমার বড় ছেলেটাও হঠাত্ চলে গেল। বাইপাস অপারেশন করাতে গিয়ে। ও তখন মাত্র বিয়াল্লিশ। ভেবেছিলাম নিজেকে শেষ করে দেব। কিন্তু কী ভাবে যেন সামলে নিয়েছি। যা হোক করে ব্যস্ত থেকেছি। এখন সেই ব্যস্ততাটাই যদি চলে যায়...!” বুজে আসে ললিতার গলা।
ছোট ছেলে থাকেন গল্ফ গ্রিনে। তাঁর ভরাট সংসার। ওখানেও তো চলে যেতে পারেন? উত্তরে বলেন, “সারাটা জীবন স্বাধীনভাবে থেকেছি। আমার এই ভাল। ওরা আসে, আমি যাই। আমার নাতিদের সঙ্গেও খুব ভাব। এই ফ্ল্যাটেও তো কত স্মৃতি। সে সবও যে বড় মায়ার। সহজে ছেড়ে যেতে মন চায়!”
খাঁ খাঁ ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলোই একমাত্র সঙ্গী ওঁর। “আমাদের ম্যাডক্স স্কোয়্যারের বাড়ির কথা প্রায়ই মনে পড়ে। গান, বাজনা, নাচ, অভিনয় আমাদের বাড়ির সবাই কিছু না কিছু করতই। ও পাড়ায় সরযূদেবী থাকতেন। সেখানে প্রায়ই উত্তমকুমার আসতেন। ওই বাড়িতে ওঁকে প্রথম দেখার পর, মনে আছে রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি,” এখনও ললিতা আরক্ত হন সেই স্মৃতিতে।
“বেণু, আমি, সাবিত্রী আর উত্তম খুব বন্ধু ছিলাম। কী যে হুল্লোড় হত! এর ওর বাড়িতে পার্টি। আড্ডা। হুশ করে দিনগুলো কেমন চলে গেল!” বলছিলেন ললিতা। |
|
এখন ললিতা |
ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে কাজ শুরু করার পর মাঝে চলে গিয়েছিলেন মুম্বই, “বেশির ভাগটা ওখানেই থাকতাম। বান্দ্রায়। এখন যেখানে শাহরুখ খানের বাড়ি, তার কাছেই। মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতাম। কিন্তু কোথাও কিছুতেই থিতু হতে পারলাম না। দোষটা বোধহয় আমারই,” বলছিলেন ললিতা।
কিন্তু কেন? উত্তরে বললেন, “আসলে কোন কাজটা করতে হয়, কোনটা ছাড়তে হয়, জানতাম না। যে যা বলেছেন, করে গিয়েছি। মাঝখান থেকে ভুলভাল ছবিতে নেমে বি-গ্রেড ছাপ্পা পেয়ে গেলাম মুম্বইয়ে। কিন্তু হাল ছাড়িনি কোনও দিনও। অভিনয় যে আমার প্যাশন। তখনও, আজও।”
গয়না বেচে থিয়েটার কোম্পানি খুলেছেন। মান্ডি হাউসে দৌড়ঝাঁপ করে পরিচালক রাজা সেনের দুটি ছবিতে প্রযোজনা করেছেন। যাত্রায় নেমেছেন। সারকারিনাতেও নাটক করেছেন। “কিন্তু তেমন বড় পরিচালকের ডাক পেলাম কই! এক এক সময় মনে হয়, পড়াশুনোটা ছেড়ে এ লাইনে আসাটা ভুল হয়েছিল,” বলছিলেন ’৫৬ সালে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ললিতাদেবী, “এমএ পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়ে স্কুলের চাকরি নিলাম। আমার বাবা, শাশুড়ি কত বারণ করেছিলেন, শুনিনি। কী জানি, হয়তো এটাই ডেস্টিনি ছিল!”
ডেস্টিনি! অদৃষ্ট! তাকে সার মেনেও জীবনের সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কে আজও হাল ছাড়তে নারাজ ললিতা চট্টোপাধ্যায়।
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|