সপ্তডিঙা যে ডুবতে বসেছে, তা আগেভাগেই টের পেয়েছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। মার্চ মাসের শেষ দিকে তাই একটি ট্রাস্ট তৈরি করে সারদা গোষ্ঠীর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই ট্রাস্টে সবার উপরে ছিল বিতর্কিত প্রাক্তন বিচারপতি সৌমিত্র সেনের নাম। ট্রাস্ট গঠনের খসড়া দেখে ঠিকঠাক করে দিয়েছিলেন তিনিই।
শুধু সৌমিত্রবাবু নন, ট্রাস্টে ছিল সংস্থার অন্য দুই কর্তা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেশ বালডিয়ার নামও। যদিও বালডিয়া দাবি করছেন, তাঁর নাম যে ট্রাস্টি হিসেবে রয়েছে, তা তিনি জানতেন না। শুক্রবার তিনি বলেন, “আমি সারদা গোষ্ঠীকে আইনি সহায়তা দিতাম। তবে ট্রাস্টি হিসেবে আমাকে রাখার পরিকল্পনার কথা শুনিনি।”
সৌমিত্রবাবু অবশ্য নিজের নাম থাকার কথা স্বীকার করছেন। তাঁর কথায়, “আমাকে রেখে ওই ট্রাস্ট করা হয়েছিল। আমি সেই ড্রাফট ঠিকঠাক করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের নামও ট্রাস্টিতে ঢোকানো হয়েছিল বলে মনে পড়ছে।”
এই ট্রাস্ট গঠনের কথা সারদা গোষ্ঠীর বড় কর্তাদের ই-মেল করে জানিয়ে দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। সুদীপ্তবাবু লিখেছিলেন, “‘এখন থেকে ওই তিন জন ট্রাস্টটি পরিচালনা করবেন। সংস্থার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ভার নেবে এই ট্রাস্ট। লগ্নিকারী ও এজেন্টদের সুরক্ষার স্বার্থে অথবা টাকাপয়সা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সম্পত্তি বিক্রির প্রয়োজন হলে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে ট্রাস্ট-ই। এই ট্রাস্ট সংস্থার সম্পত্তির মূল্যায়ন প্রতিবেদন (অ্যাসেট ভ্যালুয়েশন রিপোর্ট), ব্যালেন্স শিট, পরিচালন-ব্যয় (ম্যানেজমেন্ট কস্ট) সর্বোপরি সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের চিত্র ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সদস্যদের জানাবে।” ওই ই-মেলেই সুদীপ্ত ঘোষণা করেন, “এখন থেকে কোম্পানি কেবলমাত্র নির্মাণ ও আমদানি-রফতানির ব্যবসা করবে। বাকি সমস্ত বিভাগ আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
এখন প্রশ্ন উঠছে, সারদার হাজার হাজার কর্তা-কর্মী থাকা সত্ত্বেও সমস্ত সম্পত্তির জামিনদার হিসেবে সৌমিত্রবাবুকেই কেন ট্রাস্টে রাখা হল? সারদার কর্তারা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি সারদার অফিসে ঘন ঘন যাতায়াত করতে দেখা দেত সৌমিত্রবাবুকে। বিভিন্ন আইনি সহায়তা ও চিঠির বয়ান তৈরির জন্য প্রাক্তন এই বিচারপতিকে ভরসা করতেন সুদীপ্ত। সারদার এক অ্যাকাউন্টস এগজিকিউটিভ জানান, সংস্থার এক জন কর্তা হিসাবে অন্যদের মতো মাসিক বেতনও পেতেন ওই বিচারপতি। সৌমিত্রবাবু এ প্রসঙ্গে বলেন, “মাসিক বেতন পেয়েছি। তবে শেষের দিকে বেশ কয়েকটা চেক বাউন্স হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে বাকি চেক জমা দিইনি।”
সারদার মতো একটি ভুঁইফোঁড় সংস্থার সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে পড়লেন এক জন প্রাক্তন বিচারপতি? সৌমিত্রবাবু বলেন, “২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ অসমে একটি চ্যানেল ও একটি প্রকল্পের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে যায় সারদা। সেই সময়ে আইনি সহায়তার জন্য ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে।” তখন সারদা গোষ্ঠীর থেকে পারিশ্রমিক নিতেন কি তিনি?
বিচারপতি বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি সহায়তার জন্য ওরা আমাকে এককালীন টাকা দিয়েছে।” তার পরে সারদার মতো একটি সংস্থার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ালেন কেন? সৌমিত্রবাবুর উত্তর, “মানুষের টাকা নিয়ে প্রতারণা হবে প্রথমে বুঝতে পারিনি। সংস্থার এত কর্মী, তরুণ আইনজীবী বিপাকে পড়বেন, তা-ও বুঝিনি।”
এর আগে গচ্ছিত টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বিচারপতি সৌমিত্রর বিরুদ্ধে। প্রথমে সৌমিত্রবাবু হাত থেকে হাইকোর্টে বিচারপতির দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ইমপিচমেন্টের ফল বেরোনোর আগেই বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন সৌমিত্রবাবু। |