বুধবার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাছে আমাদের হারের পর দেখলাম জাতীয় দলে আমার সতীর্থ আর আমার ভাল বন্ধু হরভজন সিংহ একটা টুইট করেছে। বলেছে, ‘রেসটা কী ভাবে শুরু করছ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কী ভাবে শেষ করছ, সেটাই জরুরি।’ এর আগেও কথাটা শুনেছি। এখন আমার যা অবস্থা, তার চেয়েও দুঃখের সময়ে কথাটা কানে এসেছে। এটা আমার জীবনের একটা গল্প, যেটা আপনাদের অনেকেই বোধহয় জানেন না।
তখন ক্লাস টেনে পড়ি। ক্রিকেটার হিসেবে বেশ ভাল হলেও ছাত্র হিসেবে সাধারণের চেয়ে সামান্য উপরে ছিলাম। পড়াশোনাকে পিছনে ফেলে দিয়ে তখন ক্রিকেট আমার জীবনে ক্রমশ বেশি জায়গা করে নিচ্ছে। নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলাম, যেখানে স্কোরবোর্ডের সংখ্যাগুলো আমার কাছে ক্লাসের রিপোর্ট কার্ডের সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে যখন আমাকে ক্রিকেট প্রতিভা বলে প্রশংসা করা হত, তখন নিজেকে রাজার মতো মনে হত। সকালবেলার অ্যাসেম্বলির জন্য মুখিয়ে থাকতাম। যখন ক্রিকেটীয় কীর্তির জন্য বারবার আমার নামটা ঘোষণা করা হত। বিশাল হাবভাব নিয়ে হাঁটতাম না যদিও, তবু বুঝতে পারতাম যে আমার জনপ্রিয়তা বেশ বেড়ে চলেছে। ওই সময় মার্কিন একটা কমেডি শো-ও খুব জনপ্রিয় ছিল‘দ্য ওয়ান্ডার ইয়ার্স’।
হঠাৎই বেলুনটা ফেটে গেল। ক্লাস টেনের পরীক্ষায় ফেল করলাম।
আমার জগৎটা চুরমার হয়ে গেল। প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ক্রিকেটের ‘উঠতি প্রতিভা’র সামনে চলে এল নিজের জুনিয়রদের সঙ্গে ক্লাস করার আশঙ্কা। আর ঠিক এই সময়েই সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে খাঁটি পরামর্শটা পেয়েছিলাম। আমার মা আর মামা দু’জনেই বইয়ের পোকা। বিশেষ করে আমার মামা সব অর্থেই আমার জীবনের, আমার জগতের স্তম্ভ। মা আর মামা দু’জনেই আমাকে একটা কথা বলতেন। ভাজ্জি যেটা টুইট করেছে, অনেকটা সে রকমই। ‘জীবনে প্রথম ল্যাপের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ শেষ ল্যাপটা।’ পরপর কয়েকটা ম্যাচ হারের পর স্কুলপড়ুয়া হিসেবে পাওয়া সেই পরামর্শটা হঠাৎ করে আবার মনে পড়ে গেল। |
তখন আমার বয়স কম হলেও মা-মামার বার্তাটা খুব ভাল করে বুঝে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন, দিল্লির মডার্ন স্কুলে পড়া একটা ছোট ছেলের কাছে এই ব্যাপারগুলো যথেষ্ট ভয়ের। তবু খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ব্যাপারটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলাম। আজ যখন ওই সময়টার কথা মনে পড়ে, তখন মনে হয় বোধহয় ঈশ্বর ওটা করেছিলেন আমাকে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা দিতে। ওই দিনের পর থেকে আমি অনেক বার কামব্যাক করেছি। যার অন্যতম প্রত্যাবর্তনটা ঘটেছিল ইংল্যান্ডের ধুসর আকাশের নীচে।
২০০৭-এ ভারতের ইংল্যান্ড সফরের কথা বলছি। টেস্টে তখন ওয়াসিম জাফর আর দীনেশ কার্তিক ওপেন করত বলে রান করার চেয়ে আমি বেশি করে শিখেছিলাম কী করে ক্রিকেটারদের জন্য এনার্জি ড্রিঙ্ক তৈরি করতে হয়! কিচ্ছু ঠিকঠাক যাচ্ছিল না। সাউদাম্পটনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে মোটে তিন রান করলাম। ভেতরকার রাক্ষসগুলো চিৎকার করে যাচ্ছিল তোমার সময় শেষ।
দ্বিতীয় ম্যাচটা ছিল ২ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। লিডসে। মেঘলা আকাশের নীচে টস হেরে আমরা প্রথমে ব্যাট করছিলাম। আমার তিন নম্বরে ব্যাট করার কথা ছিল। ড্রেসিংরুমে অপেক্ষা করছিলাম যখন, আমার সঙ্গী ছিল মনের ভেতরকার সন্দেহগুলো। হঠাৎ করে কানের কাছে কে ফিসফিস করে উঠল, ‘গৌতম, এটাই হয়তো তোমার শেষ সুযোগ। বহুত মুশকিল সে টিম মে ডলওয়ায়া হ্যায়। অনেক কষ্টে তোমাকে টিমে ঢুকিয়েছি!’ কথাগুলো বলেছিলেন ওই সফরের নির্বাচক প্যানেলের এক সদস্য। ওনার টাইমিং এর চেয়ে খারাপ হতে পারত না। ঠিক তখনই যে তেন্ডুলকর আউট হয়ে গেল। আর আমাকে ব্যাট করতে নামতে হল।
ক্রিজে প্রথম কয়েক মিনিট মনে হচ্ছিল আমি বুঝি একটা ওয়াশিং মেশিনের ভেতর ঢুকে পড়েছি। টুইস্ট, টার্ন, স্ট্রেচ কী কী না করেছিলাম! তার পর নিজেকে সামলে কেরিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাফসেঞ্চুরিটা করলাম। ৬৬ বলে ৫১, সঙ্গে চারটে বাউন্ডারি। তখনই মনে হয়েছিল দারুণ কামব্যাক করলাম। পরের ম্যাচে ৪৭ করলাম, আর তার পর দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বাকিটা ইতিহাস।
পেপসি আইপিএলে টানা হার তাই আমার কাছে একটা ইঙ্গিত যে, ঈশ্বর আবার আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। আর সময় হয়েছে মা, মামা আর এখন ভাজ্জির কথাগুলোও আবার ফিরিয়ে আনার। তুমি কী ভাবে শুরু করলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কী ভাবে শেষ করছ, সেটাই সবচেয়ে জরুরি! |