পশ্চিমবঙ্গে সরকারি অফিসে কেউ কাজ করে না, এমন একটা ধারণা খুবই প্রচলিত।
ধারণাটা অহেতুক নয়। কিন্তু সম্পূর্ণও নয়। কর্মসংস্কৃতি সব জায়গায় সমান নয়। আবার কর্মসংস্কৃতি
খারাপ হওয়ার দায় সব ক্ষেত্রে কেবল কর্মীদের দেওয়া যায় না। সমস্যাটা জটিল। |
পশ্চিমবঙ্গে অফিস-কাছারিতে কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর তাগিদ মাঝেমধ্যে উঠে থাকে। কিন্তু একটা মৌলিক প্রশ্নের সদুত্তর সচরাচর পাওয়া যায় না। কর্মসংস্কৃতি মাপা হবে কী করে? বিশেষ করে সরকারি কাজে? দশটা পাঁচটা অফিসে হাজির থাকলেই যে কর্মসংস্কৃতির ধ্বজা ওড়ে তা তো নয়, যদিও কর্মসংস্কৃতি পরিমাপ করতে সেটুকু নিশ্চিত করা বোধহয় প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
কর্মসংস্কৃতি বলতে আমরা যেটা সচরাচর বুঝে থাকি, তার অনেকটাই নির্ভর করে সরকারি অফিসে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা বেশ খারাপ। তার সঙ্গে অন্যদের অভিজ্ঞতার মিশেল ঘটিয়ে আমরা একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করি পশ্চিমবাংলায় কর্মসংস্কৃতি ভীষণ খারাপ, কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে তা একটু ভাল হলেও হতে পারে। এই ধারণা নিশ্চয়ই অহেতুক নয়। সত্যিই তো, সরকারি কর্মচারীদের একটা বড় অংশ কাজে খুব অবহেলা করেন, সিটে থাকেন না, অফিসে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যান ব্যক্তিগত কাজে, দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখেন, কোনও প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেন না, প্রচুর ভুল করেন এই রকম অভিযোগ ঝুড়ি-ঝুড়ি। মনে আছে, ২০০৩ সালে কলকাতা পুরসভায় হওয়া অভিজ্ঞতার কথা। বস্তি উন্নয়ন সম্পর্কিত তথ্যের সন্ধানে গিয়ে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বটে, কিন্তু মাঝখানে শুনতে হয়েছিল যে, অর্থনীতির গবেষণা করে শহরের উন্নতি হয় না এবং দারিদ্রও কমানো যায় না। বরং বিকেল তিনটে নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে এসপ্ল্যানেড ইস্টে জনসভায় যোগ দিলে আর রোজ কোঅর্ডিনেশন কমিটির আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করলে দেশের কিছুটা উপকার হলেও হতে পারে। |
কিন্তু এ রাজ্যেই আবার অনেক সরকারি অফিস আছে, যেখানে দক্ষ কর্মচারী আছেন এবং তাঁরা পরিশ্রম করতে সদাই উন্মুখ, অথচ প্রায় কোনও কাজ নেই। একটি দফতরে প্রয়োজনের থেকে বেশি চাকরি সৃষ্টি করা হয়ে থাকলে তা ব্যক্তিবিশেষের সমস্যা হতে পারে না। সুতরাং, সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে গেলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা পরিমাপের নানা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সরকারি দফতরে কর্মী-মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে কর্মীদের শাস্তি বা পুরস্কারের যথার্থ ব্যবস্থা করা এ দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি অফিসে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের ফলেও ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির সঙ্গে গোষ্ঠীগত দায়বদ্ধতার বিরোধ ঘটে। তার সঙ্গে বিভিন্ন দুর্নীতি উপর মহল থেকে নীচের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তাঁরাও স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন না। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যেতেও অনেক সময় টেবিলের নীচে আর্থিক লেনদেন করতে হয়। এই সংস্কৃতিতে এক জন সৎ কর্মচারী বিনা লেনদেনে ফাইল ছেড়ে দিলে তাঁর কপালে দুর্ভোগ অবশ্যম্ভাবী। এই সমস্যাগুলো সার্বিক ভাবে কর্মসংস্কৃতিতে ছাপ ফেলে। সুতরাং, কর্মসংস্কৃতি যথাযথ পরিমাপ করতে গেলে কাজে ফাঁকি, দুর্নীতি, কাজের অভাব, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ইত্যাদি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, সরকারই বা কতটা দায়বদ্ধ কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে। যাঁরা ভাঙা ঝরঝরে সরকারি বাস চালান, দিনে আট ঘণ্টা, তাঁদের দৈনন্দিন দুর্গতির কথা কর্মী সংগঠন মারফত সরকারের কানে কোনওদিন পৌঁছয় কি? সরকার চাকরি দিয়েছে, কিন্তু কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে অক্ষম। এই কারণেও তো কর্মসংস্কৃতি সেই তলানিতেই ঠেকবে।
কাজে ফাঁকি এবং দুর্নীতি বন্ধ করা খরচসাপেক্ষ এবং বহু সমস্যাসঙ্কুল। সরকারি উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেষার মূল্যায়ন করা আরও শক্ত, কারণ এর অনেকগুলোরই, যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ ও প্রশাসন, সামাজিক সুরক্ষা এবং সমগোত্রীয় সেবামূলক কাজের বাজারি ‘দাম’ নির্ধারণ করা যায় না। ফলে এই ধরনের পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কাজের দাম নির্ধারণ করাও বেশ কঠিন। তবে আরও পথ রয়েছে। যে পরিষেবাগুলোর আপেক্ষিক মূল্যায়ন করা যায়, সেগুলোর গুরুত্বও পরিমাপ করা সম্ভব। এর সাহায্যে পরিষেবাটির বাজারি মূল্যের একটি ধারণা তৈরি করা সম্ভব। দমকল পরিষেবার কথাই ধরুন। গুদামে আগুন লাগলে তা নেভানোর দাম খোলা বাজারে নির্ণয় করা যায় না, কিন্তু ধরা যাক এক কিলোমিটারের মধ্যে দমকল আছে এমন জায়গায় বাড়ি-জমি-ফ্ল্যাটের দাম কত, তার হিসেব তো হাতের কাছেই রয়েছে। এর ভিত্তিতে দমকল পরিষেবা এবং তার কর্মীদের উৎপাদনশীলতার মূল্যায়ন অবশ্যই করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত একটি দেশেও নাকি সরকারি দফতর সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা বলছে যে, ৯৪ শতাংশ কর্মী মনে করেন যে, কর্তৃপক্ষ যদি সব কর্মীর সঙ্গে সমান আচরণ করে, তা হলে সবাই ভাল করে কাজ করবে। ৯০ শতাংশ মনে করেন যে, সরকারি কাজে সহকর্মীর উপর নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ার দরুন সবাইকেই দায়িত্বশীল হতে হবে এবং ৮২ শতাংশ মনে করেন যে, কর্তৃপক্ষ তাদের ভাল উপদেশেও কোনও দিন কর্ণপাত করে না। বিলেতে কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে কিছু দিন আগে একটি বৃহৎ সরকারি সংস্থায় কাজের ধরন অনুযায়ী ছোট ছোট দল তৈরি করা হয়। ছোট দলে কাজ করার অসুবিধে হল, এখানে ফাঁকি ধরা পড়ে চট করে এবং অন্যের ঘাড়ে কাজের ভার চাপিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায় না। এর সঙ্গে দলের উৎপাদনশীলতার উপর ভিত্তি করে কিছু ‘ইনসেন্টিভ’-এর বন্দোবস্ত রয়েছে। এই পদ্ধতিতে সেই সরকারি দফতরটির উৎপাদন বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ।
সমস্যাটা জটিল। নানা ধরনের পরিসংখ্যানের সাহায্যে কর্মসংস্কৃতি মূল্যায়নের একটা মাপকাঠি নিশ্চয়ই তৈরি করা যায়। পরিষেবার খরচ কত, কত জনকে পরিষেবা দেওয়া হল, তাদের মূল্যায়ন কী রকম, কাজের পরিবেশ সন্তোষজনক কি না, কর্মীরা চাকরি ছাড়তে চান কি না, ইত্যাদি সব কিছুই সেই মাপকাঠি নির্মাণের কাজে লাগতে পারে। একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়: কর্মসংস্কৃতি উন্নত করার সদিচ্ছা কর্তৃপক্ষের আছে তো?
কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক |