ওড়িশার নিয়মগিরি অঞ্চলে বক্সাইটের খনি চালু করতে গেলে আগে গ্রামসভার অনুমতি নিতে হবে,
জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় আদিবাসী মানুষের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে এক নতুন স্বীকৃতি দিল। |
সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এক রায়ে ওড়িশার নিয়মগিরি পর্বতাঞ্চলে বিশাল মাইনিং কোম্পানি ‘বেদান্ত’, যা এর আগে স্টারলাইট নামে পরিচিত ছিল, তার বক্সাইট উত্তোলনের কাজ পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করেছে, যতক্ষণ না তারা স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির গ্রামসভার অনুমোদন পায়। আজকের ভারতে এই রায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশেষ প্রকল্পটি নিয়ে যে সব অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে আলোচনার স্থান এটা নয়। কিন্তু সাধারণ ভাবে, বিভিন্ন বন পাহাড় বা নদী উপত্যকায় বিভিন্ন আকরিক, পাথর এমনকী মোরাম মাটি, নদীর বুকের বালি পর্যন্ত বেহিসাব তুলে নেওয়া ও সরবরাহ করা এখন এ দেশে কম বেশি ক্ষমতাশালী কিছু লোকের দ্রুত অর্থোপার্জনের পথ হয়ে উঠেছে। প্রাচীন অরণ্য ধ্বংস, জলের প্রবাহপথে বিশৃঙ্খলা, উপরিতলের মিহি মাটির স্তরের অশেষ ক্ষতি হয়ে চলেছে। এই ভূস্তরের এক ইঞ্চি তৈরি হতে হাজারখানেক বছর লাগে, এ মাটি পৃথিবীর বীজ-ফসল-বৃক্ষ সমূহের ধাত্রী। এই ধ্বংসলীলার ফল বিপর্যয়ের চেহারা নিয়ে দেখা দিচ্ছে। তবু বাড়ছে অবিমৃশ্যকারী লোভ। এবং, এ বিষয়ে আইন ভেঙে কেউ শাস্তি পেয়েছে, এমন ঘটনা মনে পড়া মুশকিল। পৃথিবীর যে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির সূক্ষ্ম, জটিল ও বিচিত্র যোগাযোগে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এই নীল-সবুজ গ্রহটিতে জীবিত রয়েছে, কিছু মানুষের ‘লাভ’ বিষয়ক ধারণার দরুন সেই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে ক্রমশ বিপজ্জনক জায়গায় চলে যাচ্ছে। এই যথা-ইচ্ছা খনন আদালতের রায়ের ফলে হয়তো কিছু নিয়ন্ত্রিত হবে। |
নিয়মগিরি অঞ্চলে অ্যালুমিনিয়ামের আকরিক বক্সাইট নিষ্কাশনের বিপক্ষে স্থানীয় মানুষদের একটি প্রধান আপত্তি ছিল এই যে, সেখানে যে সব পবিত্র জলের উৎস আছে, নষ্ট হলে দেবতার অভিশাপে জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাবে। অতীতের কোন অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা এ কথা বলতে পেরেছেন জানি না, কিন্তু ঘটনা হল, বক্সাইট উত্তোলনের পর যে ‘রেড মাড’ ছড়িয়ে পড়ে তাতে সেই অঞ্চলের সব উদ্ভিদ, এমনকী ঘাসও মরে যায়। এ কথা অস্ট্রেলিয়াসহ বহু জায়গায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। দেবতার সেই কোপ থেকে নিয়মগিরি রক্ষা পেল, অন্তত আপাতত।
তবে আমার কাছে এই রায়ের গুরুত্ব কেবল প্রাকৃতিক সংরক্ষণের কারণে নয়। জলসহ নানান প্রাকৃতিক সম্পদের দায়িত্বজ্ঞানহীন উত্তোলন ও অতিব্যবহারের বিরুদ্ধে সমস্ত পৃথিবীতে যে জনমত গড়ে উঠছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের এমন নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা, সুলভ না হলেও, অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু খনন নিয়ন্ত্রণের জন্য আদালতের উচ্চারিত যুক্তিটি এ ক্ষেত্রে অসামান্য তাৎপর্য বহন করে।
রায়টিতে বলা হয়েছে, আদিবাসী ও অরণ্য-বাসিন্দাদের (ট্র্যাডিশনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স) ধর্ম ও বিশ্বাস পালনের স্বাধীনতায় বাধা পড়ে, এমন কোনও প্রকল্পের কাজ তাঁদের গ্রামসভার সম্পূর্ণ অনুমোদন ব্যতিরেকে করা যাবে না। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ ও ২৬ নং ধারার উল্লেখ তিন বিচারকের ঘোষিত এই রায়কে এক অসামান্য গুরুত্ব দিয়েছে। ২৫ ও ২৬ নং ধারা, যা কিনা যথাক্রমে ধর্ম-বিশ্বাস আচরণ ও প্রচার এবং ধর্মীয় আচরণবিধির অনুকূল অবস্থা রক্ষার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, তা ভারতীয় গণতন্ত্রকে এক সামাজিক সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা দিয়েছিল। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার শতকরা এগারো ভাগের চেয়েও বেশি সংখ্যা যাঁদের, সেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও ধর্ম-সাংস্কৃতিক আচরণবিধি এত কাল সেই স্বীকৃতির বাইরে ছিল।
এ দেশের প্রায় সমস্ত আদিবাসীগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ধর্ম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। গভীর ভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করেন এই মানুষরা। সেই গোষ্ঠীর মধ্যে যেমন তাঁদের স্ব-সমাজের সদস্যরা পড়েন, ঠিক তেমনই অন্তর্ভুক্ত থাকে তাঁদের ঘর-উঠোন, গোয়াল, বনের গাছ, লতা ও গুল্ম, পালিত ও বন্য পশুপাখি, ফল-ফসল নদী পুকুর টিলা। নির্দিষ্ট তাঁদের ঘরের ধরন ও সজ্জা। নির্দিষ্ট তার উপকরণ ও নিয়ম। অসংখ্য বৈচিত্রময় নিয়মে সংবৃত তাঁদের খাদ্যাখাদ্য বিধি, জলক্ষেত্র ব্যবহারের নিয়ম। মন দিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যায়, নানা ভাবে এই সব বিধি তাঁদের আশেপাশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহকে রক্ষা করে, যদিও সেখান থেকেই জীবনযাপন ও সৌন্দর্যসাধনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ আদিবাসী বা জঙ্গলনিবাসী মানুষরা হাজার বছর ধরে সংগ্রহ এবং ব্যবহার করে এসেছেন। প্রকৃতির এই সযত্নরক্ষণই আদিবাসীর ধর্ম, তা সে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় হোক, বস্তারের আবুঝমাড়, ওড়িশার নিয়মগিরি কি পশ্চিম মেঘালয়ের বালপাক্রাম পর্বত। এমনকী যে সব জায়গায় আজ আর জঙ্গল নেই, জঙ্গল কেটে ঘাসজমি হাসিল করার উদ্দেশ্যে আদিবাসীর হাতে কুড়ুল ধরিয়ে দিয়ে যেখানে বন কেটে ‘খুটকাট্টি গ্রাম’ পত্তন করিয়েছিল দেশি-বিদেশি ‘দিকু’রা, সে সব জায়গার মানুষরা আজও আদিপ্রাণ বৃক্ষকে দেবতাজ্ঞানে রক্ষা করেন। জঙ্গল পাহাড় তাঁদের দেবতা বোঙ্গা। পৃথিবীর এক বড় সংখ্যক শুভচিন্তক মানুষ আজ ‘সভ্যতা’র সংকটকালে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহকে অমূল্য জ্ঞানে রক্ষা করার কথা বলছেন। তাঁদেরও বহু আগে থেকে এ পৃথিবীর, এ দেশের নানান আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষরা প্রকৃতির সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ সম্পর্ককে নিজেদের সংস্কৃতি বলে সহজ-পালন করেন। শালবনে ফুল ফুটলে তাঁদের নতুন বছর শুরু হয়। কোন কোন গাছ এক সঙ্গে থাকলে কাছাকাছি জলের উৎস থাকবে, এ তাঁরা নিশ্চিতজ্ঞানে জানেন, মাটি ফুটে ওঠা জলধারা এই মানুষদের কাছে মাতৃধারা, তার পবিত্রতা কেউ নষ্ট করে না। অরুণাচলের কোথাও কোথাও জঙ্গলের বাঘ মারা গেলে আত্মীয়বিয়োগে সারা গ্রাম অশৌচ পালন করে। এই যত্ন ও মর্যাদা আদিবাসীদের হাতে প্রকৃতিকে সবচেয়ে সুরক্ষিত রেখেছে। আদিবাসী ও জঙ্গলনিবাসী মানুষদের ধর্ম ও সংস্কৃতি তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে জড়ানো, স্থানিকতার সঙ্গে অচ্ছেদসম্ভব। ওড়িশার কোয়া গোষ্ঠীর লোকদের সম্পর্কে বলা হয়, তাঁরা বাঁশ দিয়ে কেবল জল রাখবার কলসি আর ভাত রাঁধবার হাঁড়ি ছাড়া সংসারের আর সব কিছু তৈরি করতে পারেন। তাঁদের বসতি অঞ্চলের আশপাশ কিন্তু কখনও বাঁশঝাড়-শূন্য হয় না।
উন্নয়ন প্রকল্পে এর আগে বহু বার এ দেশে আদিবাসীরা উচ্ছেদ হয়েছেন। তাঁদের বাসভূমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সবচেয়ে বেশি উচ্ছেদ হয়েছেন তাঁরাই। অনেক ক্ষেত্রেই পুনর্বাসনের ‘প্যাকেজ’ও ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু আদিবাসী বা জঙ্গলনিবাসী মানুষদের নিজস্ব গ্রাম বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, স্থানিকতা থেকে চ্যুত কোনও যথার্থ পুনর্বাসন হয় না, হতে পারে না। তাতে তাঁদের কেউ কেউ হয়তো প্রাণে বাঁচেন, কিন্তু জাতিগোষ্ঠী হিসেবে লুপ্ত হয়ে যান। শহর-জীবনের তলানিতে আরও ছিন্নমূল জনসংখ্যার ভার যুক্ত হয়। কঙ্গো, ব্রাজিল, মার্কিন দেশের আপাচে, ভারতবর্ষে আন্দামান, উত্তর-পূর্বের বহু অঞ্চল... তালিকা ক্রমবর্ধমান ও আত্মক্ষয়ী। ‘যে কোনও মূল্যে উন্নয়ন’কামী আগ্রাসনের মুখে সুপ্রিম কোর্টের রায় কতটা সংযম আনতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে গ্রামসভাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, সভা যেন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং চাপমুক্ত ভাবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগের নির্দেশও দিয়েছেন। তবু পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে ভয় হয়। কোন কোন মহল থেকে কত ভাবে এই সব সুস্থ নাগরিক অধিকারের প্রয়োগে বাধা আসতে পারে, তা ভেবে দুশ্চিন্তা হয়। তবে তাতে এই রায়ের গুরুত্ব কমে না। ধর্ম পালন ও আচরণের বিষয়টি এ দেশের শিক্ষিত সমাজে ঈষৎ সংকোচের, পিছিয়ে থাকার দ্যোতক ছিল ও আছে। অথচ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিকতার চেয়ে অনেক বেশি করে দৈনন্দিন সংস্কৃতির অঙ্গ। আবার, রামমন্দিরের আগে-পরে ধর্ম সরাসরি রাজনীতির ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এখন কারও কারও মনে হতে পারে, এ দেশে ধর্মাচরণের স্বাধীনতার অধিকার ভোট ব্যাঙ্কের সমানুপাতিক। কোনও সুরক্ষাগত কারণে কালীঘাট মন্দিরের অথবা জামা মসজিদের চত্বর কিছুটা ভাঙবার প্রস্তাবও কি আসা সম্ভব? অথচ চোখের আড়ালে, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের পূজিত প্রধান জলধারাটির সংহার চলতে থাকলে সেখানে বলি পড়া ছোট ছোট জঙ্গলনিবাসী গ্রামগুলির নিরুপায় আর্তি কোথাও পৌঁছয় না। তাঁদের ধর্মবিশ্বাস গাড়োয়ালের রিক্ত জঙ্গল-পাহাড়ের ধুলোর সঙ্গে উড়ে বেড়ায় ও ধ্বংসের অপেক্ষা করে। গণতন্ত্রে মুষ্টিমেয়ের অধিকারও মর্যাদার দাবি রাখে। আদিবাসী ও জঙ্গলনিবাসী মানুষদের ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার অধিকার এ দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে স্বীকৃতি পেল, এই ঘটনার গুরুত্ব অনেক। এটি হয়তো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের, সুতরাং নাগরিকদের সুস্থ জীবনধারনের, সুরক্ষার দিকে একটি প্রথম, সুন্দর প্রস্থানবিন্দু হতে পারে, যেখান থেকে আরও বেশি বেশি মানুষ স্থির ভাবে আত্মরক্ষা ও সন্ততিদের রক্ষার কথা ভাববেন, রক্ষার চেষ্টা করবেন। |