শ্রীনগর বিমানবন্দরে বুধবার বিকেলে তাঁর ভাবলেশহীন মুখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না, এ ক’দিন এত ঝড়ঝাপটা গিয়েছে তাঁর উপর দিয়ে! আর রাত এগারোটা নাগাদ কলকাতার নিউ টাউন থানায় যখন তাঁকে প্রিজন ভ্যান থেকে নামাচ্ছে পুলিশ, তখনও তিনি নির্বিকার। দীর্ঘ যাত্রার ধকলে হয়তো একটু ক্লান্ত। কিন্তু সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের চোখেমুখে ভেঙে পড়ার লেশমাত্র চিহ্ন নেই।
বিধানগর কমিশনারেট এবং কলকাতা পুলিশের যে অফিসারেরা এ দিন কাশ্মীর থেকে নিয়ে এলেন দুই সঙ্গী-সহ ধৃত সুদীপ্তকে, তাঁরাও সারদা কর্ণধারের এই আগাগোড়া নির্লিপ্ত চেহারা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন। শ্রীনগর বিমানবন্দরে বসে থাকার সময়েও ছায়াসঙ্গিনী দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলছিলেন নীল-লাল-সাদা-কালো ঝলমলে ফুলহাতা সোয়েটার পরা সুদীপ্ত। দু’জনের মাঝের চেয়ারে বসা সংস্থার আর এক ধৃত ডিরেক্টর (যিনি পালানোর নাটকের সময়টায় গাড়িচালকও বটে) অরবিন্দ চৌহানকে টপকেই চলছিল সারদা অফিসের ‘সেন স্যার’ আর ‘ম্যাডাম’-এর কথোপকথন। পুলিশের দেওয়া চা-স্যান্ডউইচও বিনা আপত্তিতে খেয়েছেন তাঁরা। দেবযানীর পরনে ছিল লাল ফুলের কাজ করা সাদা সালোয়ার-কামিজ। গায়ে ফুলকাটা চাদর। কালো জ্যাকেট পরা অরবিন্দকেই একমাত্র কিছুটা বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। শুধু কারও সঙ্গে চোখাচোখি হলে ঝটপট রুমালে মুখ লুকোচ্ছিলেন সারদা কর্ণধার।
ফেরার পথে পুলিশ অফিসারেরা টুকটাক প্রশ্ন করেন সুদীপ্তকে। সুদীপ্ত মুখ খোলেন দিল্লি আসার পর। তিনি ঘুরিয়ে পুলিশের কাছেই জানতে চান কলকাতার হাল হকিকত। দেবযানী অবশ্য মুখ খোলেননি। যে কোনও প্রশ্নেই তাঁর জবাব ছিল, “সবার সামনে কিছু বলব না। যা বলার পরে বলব।” পুলিশের অনুমান, সুদীপ্তর আড়ালে দেবযানী হয়তো কিছু বলতে চান। ঘটনাচক্রে, দেবযানীকে দিল্লিতে আটকে রাখা হয়েছিল বলে এ দিনই থানায় অভিযোগ করেছে তাঁর পরিবার। |
মঙ্গলবার কাশ্মীরের সোনমার্গের একটি হোটেল থেকে সুদীপ্ত, দেবযানী এবং অরবিন্দকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ। গ্রেফতারের খবর পেয়ে গতকালই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ পুলিশ দল। ছ’জনের ওই দলে রয়েছেন দুই মহিলা। এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ ধৃত তিন জনকে গান্ডেরবালের মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করা হয়। ভিন্ রাজ্যের অভিযুক্তদের দেখতে আদালত চত্বরে বেশ ভিড়ও ছিল। কড়া পাহারায় একে একে প্রিজন ভ্যান থেকে নামানো হয় সুদীপ্ত, দেবযানী ও অরবিন্দকে। সারদা কর্ণধারের মুখে রুমাল বাঁধা ছিল। দেবযানীর মুখ ঢাকা ছিল না, তবে মাথায় ঘোমটা ছিল।
ধৃতদের কলকাতায় আনতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানায় এ রাজ্যের পুলিশ। ম্যাজিস্ট্রেট পারভেজ হুসেন কচরু চার দিনের ট্রানজিট রিম্যান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশ সূত্রের খবর, আদালতে তোলার আগে ধৃতদের শারীরিক পরীক্ষা হয়। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, তাঁরা সুস্থ। ট্রানজিট রিম্যান্ডে কলকাতায় নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা নেই। ইতিমধ্যে সুদীপ্তদের ব্যবহৃত স্করপিও গাড়িটি (ডব্লিউবি ২২ইউ ৬৭৪২) বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ।
সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ গো-এয়ারের বিমানে ধৃতদের নিয়ে শ্রীনগর থেকে দিল্লি পৌঁছয় পুলিশের দলটি। দিল্লি বিমানবন্দরে তিন জনকে আবার চা দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, দেবযানী সম্ভবত নিয়মিত কোনও ওষুধ খান। ওই সময়ের মধ্যে একাধিক বার তাঁকে ওষুধ খেতে দেখা গিয়েছে। কী ওষুধ, জানা যায়নি। দিল্লি-কলকাতা স্পাইসজেটের উড়ানের ৯টি টিকিট বুক করেছিল পুলিশ। কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ আধিকারিক জানান, প্রথমে বিমানের সামনের দিকের আসন নেওয়া হয়েছিল। পরে পিছনের দিকের আসনে চলে যাওয়া হয়। ওই বিমানের এক যাত্রী জানান, নীল-ক্রিম ডোরা দেওয়া শার্ট ও জিন্স পরা সুদীপ্তকে (তত ক্ষণে সোয়েটার খুলে ফেলেছেন) বিমানে তোলা হয় পিছনের দরজা দিয়ে। সুদীপ্তকে তাঁর নাম ধরে ডাকা হয়েছিল বলেই তিনি তাঁকে চিনতে পারেন বলে ওই ব্যক্তির দাবি। সুদীপ্ত বসেছিলেন ২৮ নম্বর সারিতে, প্যাসেজের পাশের আসনে। এক বারও আসন ছেড়ে ওঠেননি তিনি।
রাত সাড়ে দশটায় কলকাতায় নামে দিল্লির বিমান। নতুন টার্মিনালের বাইরে কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে আগে থেকেই হাজির ছিলেন এক দল বিক্ষোভকারী। রাত ১০টা ৩৯-এ এক নম্বর গেট দিয়ে বার করার পর বিক্ষোভকারীদের নাগাল এড়িয়ে তিন জনকে কর্ডন করে প্রিজন ভ্যানে তুলে দেয় পুলিশ। বিমানবন্দর থেকেই বিধাননগর পুলিশের সেই ভ্যানের পিছু নেয় সংবাদমাধ্যম। রাত ১১টা নাগাদ ভ্যান পৌঁছয় নিউ টাউন থানায়। অরবিন্দকে নিয়ে যাওয়া হয় বিধাননগরের ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানায়। নিউ টাউন থানায় দু’টি আলাদা ঘরে রাখা হয় সুদীপ্ত ও দেবযানীকে। দেওয়া হয় রাতের খাবার, ভাত-ডাল-সব্জি। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষের নেতৃত্বে অফিসারেরা দু’জনের সঙ্গেই প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা বলেন। এখনও পুরোদস্তুর জেরা শুরু হয়নি। আজ, বৃহস্পতিবার ডাক্তারি পরীক্ষার পর ধৃতদের বিধাননগরের এসিজেএম আদালতে তোলার কথা রয়েছে।
|