নামেই ‘সুপার স্পেশ্যালটি হসপিটাল’
চিকিৎসক-কর্মীর অভাবে ধুঁকছে জেলা হাসপাতাল

নাম- মেনকা সাহা। অপারেশন- গল ব্লাডার। নাম লিখিয়েছেন ২০১১ সালের জুলাইয়ে।
অর্ধেন্দু সরখেল। হার্নিয়া অপারেশন। নাম লিখিয়েছেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে।
ঝর্ণা বাগদি। গল ব্লাডার অপারেশন। নাম লিখিয়েছেন গত বছর মে-তে।
নিয়তি মণ্ডল। গল ব্লাডার। জুলাই, ২০১২।


সবাই বীরভূমের সিউড়ি জেলা হাসপাতালের রোগী।
এ রকম প্রায় একশোর কাছাকাছি রোগী অপেক্ষা করছেন, কবে তাঁদের নম্বর আসবে। দীর্ঘ কয়েক মাস আগে নাম নথিভুক্ত হলেও তাঁদের সংশ্লিষ্ট অপারেশনগুলি করতে পারছেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মূলত চিকিৎসক ও কর্মীর অভাবেই এই সমস্যা বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি। অথচ মাত্র মাস কয়েক আগেই জেলা সদরের এই হাসপাতালকে ‘সুপার স্পেশ্যালটি হসপিটাল’ হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ এমন একটি হাসপাতালে সামান্য ‘ট্রমা কেয়ার সেন্টার’ই (দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখমদের চিকিৎসার জন্য) নেই!
সিউড়ি হাসপাতালে সাধারণ মানুষকে উপযুক্ত পরিষেবা দিতে অনেক নতুন ইউনিট খোলা হয়েছে। বিভিন্ন রোগের পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য আনা হয়েছে বহু নতুন যন্ত্রপাতিও। তবে কেন ভাল পরিষেবা মিলছে না? সিউড়ি হাসপাতালের একটা বড় অংশের চিকিৎসকদের মত, চিকিৎসক থেকে সমস্ত স্তরের কর্মীর ঘাটতিই এর প্রধান কারণ। একই মত হাসপাতালের কর্মীদেরও। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে কেন এই ঘাটতি?
হাসপাতাল সূত্রে খবর, এর মূলে আছে এর কয়েক দশক আগের ‘স্টাফ প্যাটার্ন’। সেই ১৯৯০-৯১ সালের ‘স্টাফ প্যাটার্ন’ নিয়েই এখনও চলছে হাসপাতাল। আরও আশ্চর্যের কথা, ২১-২২ বছর আগের সেই ‘স্টাফ প্যাটার্ন’ অনুযায়ীও এখনও সমস্ত চিকিৎসক ও কর্মীপদ পূরণ করা যায়নি।
ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ দিকে কয়েক বছরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আগে যেখানে বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০-৫০০ জন রোগী আসতেন, বর্তমানে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০০-১২০০ জনে। কোনও কোনও দিন সেই সংখ্যা দুই হাজারও ছাড়িয়ে যায়। অথচ সিউড়ি সদর হাসপাতালকে সেই ১৯৮৬ সালেই ‘জেলা হাসপাতাল’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন এই হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ছিল ৫২০। তারপরে ২৭-২৮ বছর পরেও কার্যত কোনও শয্যা সংখ্যা বাড়েনি বললেই চলে। গত এক বছরে ‘নিও নাটাল কেয়ার ইউনিট’-এ ৩০ ও ‘থ্যালাসেমিয়া ডে কেয়ার’-এ ৫টি শয্যা বেড়েছে। এই ৩৫টি শয্যা বাড়লেও, এ গুলিতে শিশু ও থ্যালাসেমিয়া রোগী ছাড়া কাউকে ভর্তি করা যায় না।
এ দিকে বহির্বিভাগের মতোই হাল অন্তর্বিভাগেরও। রোগী আছে, অথচ নেই পর্যাপ্ত শয্যা। অধিকাংশ সময়ে একটি শয্যায় দু’জন, এমনকী মেঝেতেও রোগীকে শুয়ে থাকতে হয়। ফলে বিঘ্নিত হয় পরিষেবা। আবার ‘টেকনিশিয়ান’ না থাকায় বিভিন্ন দামী যন্ত্রপাতিও পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। যার অন্যতম ‘হেলথ্ সিস্টেম ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট’-এ আসা বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার যন্ত্রপাতি। ওই যন্ত্রপাতি চালানোর প্রশিক্ষণ না থাকায় সমস্যায় পড়েন চিকিৎসকেরাও। তবু কখনও কখনও খুব জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসকদের একাংশ নিজেরাই রোগীদের ওই সব পরীক্ষা করে নিতে বাধ্য হন।
জেলা হাসপাতালে যে একটি ‘ট্রমা কেয়ার সেন্টার’ গড়ে তোলার ভীষণ প্রয়োজন, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছিলেন সিউড়ির উপর দিয়ে মোরগ্রাম-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক তৈরি হওয়ার পরপরই। বহু দিন আগেই কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য দফতরের কাছে এ নিয়ে প্রস্তাবও পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু তা এত দিনেও অনুমোদন পায়নি। হাসপাতালের আরও একটি বড় সমস্যা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেহ ময়না-তদন্তের জন্য যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (‘অটোপ্সি সার্জেন’) দরকার, তাও এখানে নেই। অথচ প্রতি মাসে গড়ে অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয়েছে এমন ১০০টিরও বেশি দেহের ময়না-তদন্ত হয় এই হাসপাতালে। যা সম্পূর্ণ আইন বিরুদ্ধ। এ কথা স্বীকারও করেছেন ভারপ্রাপ্ত জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক গুরুদাস পাত্র। তাঁর কথায়, “কেন্দ্র সরকারের নিয়ম বলছে, অটোপ্সি সার্জেন ছাড়া ময়না-তদন্ত করা যাবে না।” তাই অনেক সময়ই চিকিৎসকেরা ময়না-তদন্ত করতে না চাওয়ায় মৃতদেহ নিয়ে ছুটতে হয় বর্ধমান মেডিক্যালে।
অন্য দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম বলছে, বছরে কোনও হাসপাতালে ১-১০০০টি প্রসব হলে সেখানে একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ রাখতে হবে। কিন্তু সিউড়ি হাসপাতালে বছরে পনেরো হাজার মতো প্রসব হলেও, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র ৫ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী তা হওয়ার কথা ১৫! একই চিত্র চিকিৎসকদের অন্যান্য পদগুলিতেও। কর্মী ঘাটতির কথা মেনে নিয়েও হাসপাতাল সুপার মানবেন্দ্র ঘোষের দাবি, “চিকিৎসক থেকে কর্মী, ঘাটতি তো আছেই। তার মধ্যেও হাসপাতালের পরিষেবা কিন্তু যথেষ্ট ভাল। তবে চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কর্মী পেলে আরও ভাল পরিষেবা দেওয়া যাবে।” তাঁর সংযোজন, “ক’দিন আগেই এখানে ‘মাদার চাইল্ড হাব’-এর শিলান্যাস হল। বলা যায়, হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ হওয়ার দিকে একধাপ এগোল।”
হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন তথা সাংসদ শতাব্দী রায়ের আবার দাবি, “ওই হাসপাতালের জন্য সাংসদ তহবিল থেকে বহু টাকা দিয়েছি। আগের থেকে পরিষেবা অনেক উন্নতও হয়েছে। তবে চিকিৎসক-কর্মীর অভাব শুধু সিউড়ি নয়, গোটা রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের দীর্ঘ দিনের সমস্যা। সমস্যা দূর করা নিয়ে রাজ্য সরকার চিন্তাভাবনা করছে।”
যদিও সিউড়ির তৃপ্তি অঙ্কুর, সাঁইথিয়ার সবিতা বাগদি কিংবা মহম্মদবাজারের ভারকাটা গ্রামের মনোহরা বিবি-রা কিন্তু বলে চলেছেন, “আর্থিক অভাবের জন্য হাসপাতালে যায়। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি অপারেশন হয়ে যাবে। কিন্তু হাসপাতাল বলছে ডাক্তার নাই। ডাক্তার এলে অপারেশন হবে। এখন খালি যাই আর ফিরে আসি। যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি।”
তাঁদেরই মতো দুবরাজপুরের দুলালি কবিরাজরাও জানেন না কবে অপারেশন হবে!

পদে পদে সঙ্কট
পদ আছে ডেপুটেশনে প্রয়োজন
জেনারেল সার্জেন
স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ১০
অর্থোপেডিক -
চক্ষু বিশেষজ্ঞ -
শিশু বিশেষজ্ঞ
চর্ম বিশেষজ্ঞ -
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ -
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট -
রেডিওলজিস্ট
অটোপ্সি সার্জেন -
মেডিসিন -
ব্লাড ব্যাঙ্কের জন্য -
নিউরোলজিস্ট -
কার্ডিওলজিস্ট -
নেফ্রোলজিস্ট -
ইউরোলজিস্ট -
(সূত্র: সিউড়ি জেলা হাসপাতাল)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.