হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আছেন কাগজে মোড়া একটা সাদা রঙের ট্যাবলেট। তা নিয়েই এক বার সরকারি হাসপাতালের দরজায়, আর এক বার পুলিশ মর্গে এবং থানায় পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন বছর পঁয়ত্রিশের তৃষ্ণা মান্না।
বড় মেয়ে অয়ন্তিকার মৃত্যুর তদন্তে গত এক মাস ধরে পুলিশ বা হাসপাতাল কেউ তাঁকে কোনও সাহায্য করছে না বলে অভিযোগ টবিন রোডের নেতাজি কলোনির বাসিন্দা তৃষ্ণার। প্রেসক্রিপশন, বেডটিকিট-সহ চিকিত্সা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে অস্বীকার করেছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। পাশাপাশি, অয়ন্তিকার মৃত্যুর পরে এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হাতে আসেনি তাঁর ময়না-তদন্ত রিপোর্ট। থমকে আছে তদন্ত। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। চিকিত্সার কাগজ না-পেলে তারাও তদন্ত এগোতে পারছে না।
এখন ভরসা বলতে মায়ের মুঠোবন্দি সেই একটা ট্যাবলেট, গত ১৮ মার্চ যেটা খাওয়ার পরেই নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগে এগারো বছরের অয়ন্তিকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল বলে অভিযোগ। সরকারি ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ, দিশাহারা মা এখন খুঁজে চলেছেন, কোথা থেকে সেই ট্যাবলেট পরীক্ষা করানো যায়। হয়তো সেখান থেকে পাওয়া যেতে পারে মেয়ের মৃত্যুর সূত্র।
|
অয়ন্তিকা মান্না |
বরাহনগর মোহন গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত অয়ন্তিকা। পড়াশোনায় ভাল। শান্ত, মিষ্টি মেয়ে। মাঝেমাঝে হাঁপানিতে কষ্ট পেত। মার্চের গোড়ার দিকে মাধ্যমিক পরীক্ষার ছুটিতে দেশের বাড়ি আরামবাগে বেড়াতে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে ফিরে অল্প জ্বর হয়, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের আউটডোরে দেখিয়ে ১৬ মার্চ, শনিবার পেডিয়াট্রিক্স বিভাগে ভর্তি করা হয় তাকে। বাড়ির লোকেরা জানান, অয়ন্তিকাকে ওষুধপত্র তেমন দেওয়া হয়নি। প্রথম দু’দিন স্যালাইন আর অক্সিজেনের উপরেই রাখা হয়েছিল। সুস্থও হয়ে উঠছিল সে।
সালফার ড্রাগে অ্যালার্জি ছিল অয়ন্তিকার। তৃষ্ণার দাবি, হাসপাতালের চিকিত্সক ও নার্সদের বারবার সে বিষয়ে জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর দাবি, “এত কিছুর পরেও সোমবার, ১৮ মার্চ সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ ওয়ার্ডের নার্স আমাকে আড়াইখানা ট্যাবলেট দিয়ে মেয়েকে খাওয়াতে বলেন। দেড়টা ট্যাবলেট খাওয়ানোর পরেই আমার মেয়ে চিত্কার করে বলে, ‘‘আমার শরীর কেমন করছে, চুলকোচ্ছে। ওরা আমাকে সালফার ড্রাগ দিয়েছে।’’ আমি পাগলের মতো ডাক্তারবাবুকে খুঁজে আনতে দৌড়োই। তিনি এসে ইঞ্জেকশন দিতে না দিতে আমার মেয়ে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আমার হাতের উপরেই মারা যায়।”
ঘটনার বিষয়ে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে হাসপাতালের রেজিস্ট্রার কুন্তল বিশ্বাস কড়া সুরে বলেন, “অন্য অনেক লেখার বিষয় রয়েছে, সে সব নিয়ে খবর লিখুন। ক্ষমতা থাকলে রোগীর পরিবার তথ্যের অধিকার আইন প্রয়োগ করে তথ্য জেনে নিক।”
কিন্তু চিকিত্সার কাগজ হাতে পাওয়া রোগীর পরিবারের অধিকারের মধ্যে পড়ে। তা ছাড়া, হাসপাতাল যে বিভাগীয় তদন্তের কথা বলেছিল, তার কী হল? সুপার দিব্যেন্দু গৌতমের বক্তব্য, “আমি এ রকম কোনও তদন্তের কথা শুনিনি।” অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ী প্রথমে বলেন, “আমি তো কোনও অর্ডার দিইনি।” পরক্ষণে আবার শুধরে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ দিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছি। কাগজপত্রগুলো সব আনিয়ে দেখতে হবে।” তদন্তে কী পাওয়া গেল? কারা কারা তদন্ত কমিটিতে আছেন? এত দিনেও কেন তদন্ত শেষ হল না, রিপোর্ট মিলল না?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অধ্যক্ষের জবাব, “আমি খুব চাপে আছি। এ সব বলতে পারব না।”
ময়না-তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে বৌবাজার থানা থেকে লালবাজারের জয়েন্ট কমিশনার (হেডকোয়ার্টার্স)-এর অফিস পর্যন্ত সব জায়গায় একই কথা, “সময় লাগবে।” |