প্রবন্ধ ২...
ব্যাঙ্ক তো আমাদের জন্য নয়
ব্বইয়ের দশকের কথা। এক প্রবল শীতের রাতে মুর্শিদাবাদের অতিথি নিবাসে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি কোনও এক স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের এজেন্ট। তাঁর কাজ ঘুরে ঘুরে গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের সংস্থাতে তা জমা দেওয়া, আর এই কাজ বাবদ সামান্য কমিশন পাওয়া। সেই প্রথম আমি জানতে পারি অন্য এক সঞ্চয়ের জগতের কথা, যেখানে রোজ টাকা জমানো যায়, মাসমাইনের মানুষের সঞ্চয়ের জগৎ থেকে যা অন্য রকম।
স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে টাকা জমানো যে কত ভয়ঙ্কর, সেই অভিজ্ঞতা আমারও কিছু হয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক গ্রামে এক জন মাঝবয়সি মা’কে কলকাতায় তার ‘গতর খাটিয়ে’ (পরিচারিকা) রোজগার করা মেয়ের টাকা সঞ্চয়িতা প্রকল্পে জলাঞ্জলি দিয়ে পাগল হয়ে যেতে দেখেছি। মেয়ের রোজগারের টাকা মা বিশ্বাসী ‘এজেন্ট’-এর কাছে রেখেছিলেন মেয়েরই বিয়ের জন্য। লেখাপড়া জানেন না বলে ব্যাঙ্কের ঝামেলায় যাননি। মদ্যপ স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাড়িতেও রাখেননি। তার পর মেয়ের সাত-আট বছরের রোজগার ‘নেই’ হয়ে গেল। মা একেবারে উন্মাদ হয়ে গেলেন। আর মা’কে দেখার জন্য মেয়ে বিয়ের কথা ভুলে গ্রামে ফিরে গেল। এ রকম মর্মান্তিক ঘটনা এ দেশের গ্রামে গ্রামে কান পাতলেই শোনা যায়। প্রতিটি ঘটনাই প্রতারণার নজির। আবার প্রতিটিই নানা কারণে একে অন্যের থেকে আলাদা, সামান্যীকরণ করে একটি সিদ্ধান্তে আসা বোধ হয় ঠিক নয়। ঢালাও ভাবে ‘বেশি সুদের লোভ’ বলে দেগে দিলেও আসল সমস্যার সমাধান হবে না।
সমস্যাটা মূলে। স্বল্প সঞ্চয় রাখার সমস্যা। একটা উদাহরণ দিই। মুর্শিদাবাদেই এক মুসলমান পরিবারের মেয়েদের সামান্য উপায় করা পয়সা জমাতে দেখেছিলাম মশলার কৌটোর মধ্যে। কারণ সেখানে পুরুষের হাত পড়ে না। সেই পয়সা যখন টাকা হয়ে যায়, তখন তা জমা পড়ে স্বল্প সঞ্চয়ের এজেন্টের কাছে। নাম করা সংস্থাই তো শুধু নয়, হাজার হাজার ছোট সংস্থাও আছে। তারা প্রথম দিকে টাকা ফেরত দেয়। তার পর এক দিন উধাও। কত বার শুনেছি, পুলিশও ডায়রি নেয়নি। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে এদের ভাল রকম যোগাযোগ থাকে।
ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষের রোজগার দৈনিক ভিত্তিতে হয়। তাই সঞ্চয়ও দৈনিক ভিত্তিতে হওয়া সুবিধাজনক। দেশের গরিব মানুষদের রোজগারের ধরনের সঙ্গে এই ধরনের সংস্থার সঞ্চয়ের ধরনটা মিলে যায়। যেটা ব্যাঙ্কের ধরনের সঙ্গে মেলে না। এখানে সামান্য পাঁচ-দশ টাকাও প্রতি দিনের জমা হিসেবে নেন এজেন্টরা। দৈনিক রোজগার থেকে সেই টাকাটা দেওয়া সহজ। ব্যাঙ্কে রেকারিং ডিপোজিটে রাখলেও মাসে এক দিন দিতে হয়, সেটা কঠিন, কারণ দশটি টাকাও তিরিশ দিন রেখে দেওয়া এঁদের পক্ষে অসম্ভব।
মানুষ আধপেটা খেয়েও ভবিষ্যতের জন্য জমায়। জমাবেও। কিন্তু সেই জায়গাটায় ব্যাঙ্ক কখনওই পৌঁছতে পারবে না, যদি না গোটা ব্যবস্থাটা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করা হয়। আমি অর্থনীতিবিদ নই। কিন্তু অভিজ্ঞতা আর সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে নিশ্চিত ভাবে দু’একটি বিষয় বুঝেছি। এক, যাঁরা দৈনিক ভিত্তিতে রোজগার করেন, যাঁদের রোজগার খুব কম, তাঁদের জন্য কিছু স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প তৈরি করা দরকার, যাতে তাঁরা নিশ্চিন্তে ও সহজে টাকা জমাতে পারেন। দুই, ব্যাঙ্ককে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। যেমন এই সংস্থাগুলো পৌঁছে যায়। এদের এজেন্টরা বাড়ি এসে টাকা নিয়ে যান। কারণ সাধারণ গরিব মানুষকে দৈনিক যত ঘন্টা খাটতে হয়, সেটা শেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোথাও গিয়ে টাকা জমা দেওয়া সম্ভব নয়।
এক এক বার এক এক রাজ্যে এ রকম ধস নামবে, আর কিছু দিন শোরগোল হবে। কাজের কাজ কী হবে কেউ জানে না। সাধারণ গরিব মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.