প্রবন্ধ ১...
মানুষকে সচেতন করতে সব দলের এক
হয়ে এগিয়ে আসা চাই, পারবেন?
প্রথমে একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। বেশ কয়েক বছর আগে খুব বেশি সুদ পাব বলে আমি একটি বেসরকারি কোম্পানির স্থায়ী আমানতে টাকা রেখেছিলাম এবং সব টাকাটা খুইয়েছিলাম। সেই সময় অনেকগুলো টাকা খুইয়ে বেগ পেয়েছিলাম, দুঃখ পেয়েছিলাম, হতদরিদ্র ছিলাম না বলে পরে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু সে কোম্পানি টাকা না দিয়ে দিব্যি পার পেয়ে গিয়েছিল। আমার শিক্ষা হয়েছিল, এ সব ব্যাপারে সরকার ছাড়া কাউকে আর বিশ্বাস করিনি কোনও দিন। স্বাভাবিক কারণেই সেই অভিজ্ঞতার কথা ইদানীং খুব মনে পড়ছে।
কয়েক মাস আগে এই পত্রিকায় একটি লেখায় (‘টাকা রাখার আগে খোঁজখবর করা ভাল’, ৩১-৩) চিট ফান্ডের মাধ্যমে সঞ্চয়ের ঝুঁকি এবং বিপদের কথা বিশদ ভাবে আলোচনা করেছিলাম। এ কথাও বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, যত ক্ষণ আমরা আমাদের সঞ্চয়ের উপর বেশ ভাল সুদ পেতে থাকি, তত ক্ষণ প্রশ্ন তুলি না, কী ভাবে বাজারে চলতি সুদের হারের চেয়ে এতটা বেশি সুদ দেওয়া হচ্ছে? বস্তুত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বিপর্যয়ের পিছনেও মূলত এই সমস্যা কাজ করেছিল। আমাদের টাকা কী ভাবে খাটছে, সেটা জানা-বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকারি ব্যাঙ্ক বা আর্থিক সংস্থার ক্ষেত্রে এই সমস্যা অপেক্ষাকৃত কম, কারণ সেখানে টাকা ফেরত পাওয়ার সরকারি গ্যারান্টি থাকে। বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে সেই সুবিধে নেই। সেখানে আমরা বাজারের গড়পড়তা সুদের চেয়ে বেশি টাকা পেতে পারি, আবার তেমনই ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারি।
বাড়তি আয় এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, যা নিয়ে অর্থনীতির তত্ত্বে বিশদ আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতির সূত্র বলে, সরকারি ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানত রেখে যদি আমি বছরে আট শতাংশ সুদ পাই আর কোনও বেসরকারি সংস্থা আমাকে বারো শতাংশ সুদ দেয়, তা হলে ওই চার শতাংশ বেশি পাচ্ছি আমি ঝুঁকি নিতে রাজি আছি বলেই। ভাল সময়ে আমি যেমন ভাল পাই, তেমনই খারাপ সময়ে খারাপই হবে, কেউ আমাকে বাঁচাতে আসবে না। এটাই স্বাভাবিক। এটা হল স্বাভাবিক ঝুঁকির কথা। এর সঙ্গে কারচুপি যুক্ত হলে সঙ্কট অন্য মাত্রা পায়। কোম্পানি লাটে উঠলে যাঁরা আমানত জোগাড় করেছেন এবং তার উপর এত দিন কমিশন পেয়েছেন, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কিন্তু যাঁদের আমানত বিপদে নিমজ্জিত সেই সাধারণ সঞ্চয়কারীদের ভয়ানক রকমের ক্ষতি হবে।
পরিণতি। শিলিগুড়ি ২২ এপ্রিল, ২০১৩ পিটিআই
যাঁদের ক্ষতি হল, তাঁদের ক্ষতিপূরণের দায় সরকারের নেওয়া উচিত কি? সহজ উত্তর: না, সেই দায় সরকারের থাকতে পারে না। কোনও ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী বা সংস্থার কারচুপির ফলে আমার আর্থিক ক্ষতি হলে আমাকে আদালতে যেতে হবে, সেখানে প্রমাণ হবে দায়টা কার কতখানি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থা আমাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল বুঝিয়েছিল কি না, প্রাসঙ্গিক নিয়মকানুন ঠিকঠাক মেনেছিল কি না, ইত্যাদি।
পাশাপাশি, এই ধরনের কারবারে কোনও কারচুপি হচ্ছে কি না, সেটা দেখা জরুরি। যাঁরা আমাদের আমানত জোগাড় করছেন, তাঁরা আমাদের সঙ্গে কারচুপি করছেন কি না, সেটা দেখা নিয়ন্ত্রকদের কাজ। এ ক্ষেত্রে বলা দরকার, আমাদের দেশে কে এই সব সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়েও অনেক দিন ধরে গড়িমসি চলেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার, কারও হাতেই সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। তার উপর, দীর্ঘকাল কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ এবং শাস্তির জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের কাজ থমকে আছে। এর ফলে অসাধু কারবার নিয়ন্ত্রণের সমস্যা বেড়েছে।
সরকার সরাসরি কিছু করতে পারে না? আমাদের অনেকেরই ‘সঞ্চয়িতা’র কাহিনি মনে আছে। শুনেছি, সঞ্চয়িতা সম্পর্কে তৎকালীন সরকারি তৎপরতার পিছনে রাজ্য সরকারের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রীর একটি বড় ভূমিকা ছিল। আইনের প্রেক্ষিতে এই ধরনের পদক্ষেপ সম্পর্কে বলা যায়, যে আর্থিক কারবার ভবিষ্যতে প্রচুর মানুষের ক্ষতি সাধন করতে পারে, এখনই তা বন্ধ করে দেওয়া নিঃসন্দেহে সাহসী কাজ। যদি কোনও কোম্পানি সরকারি নিয়মকানুন ঠিক মতো না মানে, তা হলে এমন কঠোর পদক্ষেপ সব দিক থেকেই যুক্তিযুক্ত।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, নিয়ন্ত্রণাবলি ঠিক মতো মানা হচ্ছে কি না, সরকার কেন সে দিকে সব সময় শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে বসে থাকে না? মানুষ যাতে নীতিহীন বেসরকারি ব্যবসায়ীদের কবলে গিয়ে না পড়ে, সে জন্য তৎপর থাকা অবশ্যই সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কথাটা সারা ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা জানি, সম্প্রতি কী ভাবে উত্তরপ্রদেশের একটি বড় কোম্পানির দুরবস্থা হয়েছে। সেখানকার রাজ্য সরকার বা কেন্দ্র এ সব কিছুই জানত না, এটা হজম করা শক্ত। পশ্চিমবঙ্গে অনেক কোম্পানি অনেক দিন ধরে এই ধরনের আমানত জোগাড় করার ব্যবসা চালাচ্ছে। এ সম্পর্কে জনগণকে সাবধান করে দেওয়ার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের উপর বর্তায়।
রাজ্যের পূর্ববর্তী সরকার তথা তার চালকরাও কিন্তু সেই দায়ভাগ এড়াতে পারেন না। বস্তুত, তাঁদের দায়টা এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে গুরুতর। তার কারণ, এ ধরনের কোম্পানি যখন প্রথম ব্যবসা শুরু করে, তখনই জনসাধারণকে সচেতন করার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এক বার ব্যবসা জমে উঠলে এবং গ্রাহকরা ভাল রোজগার করতে পারলে তাঁরা যে কোনও ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবেন। স্বাভাবিক, ‘ভাল সময়’কে কেউ খারাপ করতে চায় না।
অন্য দিকে, এটাও মনে রাখতে হবে যে, মানুষ যখন বেশি সুদের লোভে এই সব জায়গায় সঞ্চয় করেন তখন সেখানে অনিশ্চয়তাজনিত ঝুঁকি কতটা, বাড়তি আয়ের অনেকটাই যে সেই ঝুঁকিতে লুকিয়ে রয়েছে, সেটা তাঁকে বোঝানো দরকার। এ বিষয়ে তাঁদের মনে যাতে কোনও ভুল ধারণা তৈরি না হয়, সেটা দেখাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সব কোম্পানির মানুষজনের সঙ্গে সরকারি রাজনীতির মানুষজনের ওঠাবসা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়, কারণ গরিব, স্বল্পশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষজন এ-সব দেখেই ভাবেন কোম্পানি কতটা স্থিতিশীল, তাঁদের সঞ্চয় কতটা সুরক্ষিত। গ্রাহকেরা যে মোটেই সুরক্ষিত নন, সেই ধারণাটা তাঁদের মধ্যে না থাকলে এ-সব কোম্পানির রমরমা ব্যবসা ঠেকায় কে? এই ব্যাপারটা যে কোনও সরকারকে বুঝতে হবে। মোদ্দা কথা, ‘ঝুঁকি’র মাত্রাকে রাজনৈতিক ভাবে লঘু করা অন্যায়।
অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক এবং আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্নীতির সম্পর্ক এ দেশে অনেক দিনের। কোনও সরকারের মন্ত্রী সরাসরি সরকারি তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা চুরি করে জেলে চলে যান, যে টাকা জনসাধারণের জন্য খরচ হতে পারত। কোনও বড় সরকারি নেতা দামি দামি জমি ধুলোর দরে বেসরকারি সংস্থাকে পাইয়ে দেন। কোনও সাংসদ লজ্জার মাথা খেয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনি কিছুই জানতেন না!
পরিশেষে, কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব কম নয়। নিম্নবিত্ত মানুষ আগে ডাকঘরে স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্পে টাকা রাখতেন, সব মিলিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা পড়ত। শোনা যায় সে জাতীয় স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্পে সরকারি এজেন্সির হার খুব কমিয়ে দেওয়ায় এবং সেখানে সুদের হার কম থাকায় এজেন্টদের সঞ্চয় সংগ্রহ করার প্রবণতা ও সরকারি খাতে সঞ্চয়ের হার দুইই অনেক কমে গেছে। তাই যাঁরা এজেন্ট হতে চান, বেসরকারি সংস্থার হয়ে কাজ করতেই তাঁরা আগ্রহী হয়েছেন। এক কথায়, কেন্দ্রীয় সরকার জোর করে মানুষকে বেসরকারি সঞ্চয় সংস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এমন হলে স্বল্পসঞ্চয়ী মানুষ উপায়ান্তর না দেখে বেসরকারি আমানত সংগ্রহকারীদের হাতে গিয়ে পড়েন। তার উপরে, প্রত্যন্ত জায়গায় এখনও কোনও ব্যাঙ্ক নেই, দশ-বারো মাইল দূরে তবে একটা ব্যাঙ্ক পাওয়া যায়। গরিব মানুষ আরও বাধ্য হন চিট ফান্ডের মতো কোম্পানিতে টাকা রাখতে। আইন প্রণয়নে গাফিলতি, ডাকঘরের স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্পে উৎসাহ না দেওয়া, প্রত্যন্ত জায়গায় ব্যাঙ্ক না রাখা, এই সব কিছুই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। এ-সবের দায় কেন্দ্রীয় সরকার এড়াতে পারে না।
সমস্যা হল, নিয়ন্ত্রকরা তাদের কাজ ঠিক মতো করে না, গরিব মানুষেরও, সবার মতোই, লোভ ঊর্ধ্বমুখী এবং সঞ্চয়ের জায়গা কম, দু’তিন বার লাভের বন্যা বইয়ে এঁদের ফাঁদে ফেলা সহজ। এ সব বিষয়ে বড় আকারে সচেতনতা না বাড়ালে কোনও উপায় নেই। সে জন্য চাই একটা সত্যিকারের আন্দোলন। সব দলের রাজনীতির মানুষরা একযোগে সে আন্দোলনে নামবেন কি?

কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.