একের পর এক ধর্ষণ। শিকার সকল বয়সের। প্রৌঢ়া হইতে চার-পাঁচ বৎসরের শিশুকন্যা, কাহারও নিস্তার নাই। কোথাও একক ভাবে উপর্যুপরি ধর্ষণ, কোথাও অপহরণ করিয়া গণধর্ষণ। বিভিন্ন অপকাণ্ড দেশব্যাপী প্রতিবাদের জন্ম দিতেছে। রাজধানী দিল্লিতে বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতার প্রতীকরূপ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের দফতরে কিংবা বাসভবনে পর্যন্ত তাঁহাদের প্রতিবাদী বার্তা পৌঁছাইয়া দিতেছেন। জনসমাজের প্রতিবাদের এক নূতন রূপ তৈয়ারি হইয়াছে। ধর্ষণকারীদের কঠোরতর শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে সাড়া দিয়া আইনসভা মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত সংশোধিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করিয়াছে। এই প্রশ্নে সর্বদলীয় ঐকমত্যেরও অভাব হয় নাই।
পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা নিশ্চয়ই গুরুতর। তাহার নিন্দা ও প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেখানেই থামিয়া গেলে মস্ত ভুল হইবে। মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যাবতীয় হিংসা কেন পুলিশ বাহিনীকে সাধারণ ভাবে ক্রুদ্ধ করে না, বরং হিংসায় লিপ্তদের প্রতি নমনীয় ও সহনশীল রাখে, তাহার কারণ খোঁজা দরকার, বোঝা দরকার। সেই কারণ হয়তো নিহিত নিজ পরিবারের মধ্যে ছোটবেলা হইতে এ ধরনের হিংসা দেখিয়া বড় হওয়ার মধ্যে। সেই হিংসা সর্বব্যাপী। পণপ্রথাজনিত বধূহত্যার মধ্যে যে নৃশংস হিংসা রহিয়াছে, তাহাও কি কেবল পুরুষতন্ত্র দিয়া ব্যাখ্যা করা যায়? লক্ষ করিলে দেখা যাইবে, ধর্ষিতাদের প্রতি ধর্ষণকারী প্রায়শ যে শারীরিক নিষ্ঠুরতা দেখাইতেছে, তাহা কেবল পুরুষের যৌন লালসা চরিতার্থ করার জৈব তাগিদপ্রসূত নয়। ইহার পিছনে নিষ্ঠুরতার প্রতি, অত্যাচার ও নিগ্রহের প্রতি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক আসক্তির ক্রিয়াও থাকা সম্ভব। ভারতীয় সমাজে এই আসক্তি গড়িয়া ওঠে আশৈশব পরিবারের অভ্যন্তরেই নানা যৌন ও অযৌন হিংসার ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া। নিষ্ঠুরতা, যৌন হিংসা তাই পুরুষদের এক বড় অংশের ‘স্ব-ভাব’। ইহা লইয়া অনেক বেশি গভীর এবং ব্যাপক গবেষণা আবশ্যক।
পুলিশের সংখ্যা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি করার এবং বাহিনীকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিবার আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। সেই সঙ্গে বিচারবিভাগের তরফেও নৈতিক দায়বদ্ধতা জরুরি। এ দেশে ধর্ষকদের সাজা পাওয়ার ঘটনা এত অস্বাভাবিক রকমের কম যে, ধর্ষণকারীরা যেমন তাহাতে উৎসাহিত বোধ করে, তাহাদের শিকাররাও তেমনই ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখে না। আইন কঠোর হইলেও তাই ধর্ষণ বা যৌন হিংসায় লিপ্ত হওয়ার তাড়না কমিতে চাহে না। তবে পরিবারে, স্কুলে, প্রতিবেশীর সমাজে, নিজ সম্প্রদায়ে ও গোষ্ঠীতে হিংসার সহিত নিয়ত ঘর করার ফলে হিংসাকেই স্বাভাবিক বলিয়া মানিয়া লওয়ার যে প্রবণতা ওতপ্রোত, তাহার পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন আইনের নয়, সমাজের, সমাজভুক্ত ব্যক্তির মগ্নচৈতন্যের। ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষার কাজ’। কিন্তু কাজটি নানা ক্ষেত্রেই অচিরে শুরু করা দরকার। |