অতি দ্রুত বাড়তি উপার্জনের লোভ এই রাজ্যে অনেককেই সর্বস্বান্ত করিয়াছে। লোভ সর্বনাশা। কিন্তু তাহাকে ভিত্তিহীন বলা কঠিন। কাহার ভরসায় তাঁহারা একটি সম্পূর্ণ ভুঁইফোঁড় সংস্থার অস্বাভাবিক ‘লগ্নি’ প্রকল্পের আকর্ষণে নিজেদের সর্বস্ব তাহার হাতে তুলিয়া দিয়াছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে তাঁহারা কার্যত ব্যতিক্রমহীন ভাবে মহাকরণের দিকে, অথবা শেষ বিচারে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিতেছেন। তাঁহারা বিশ্বাস করিয়াছিলেন, এই সংস্থার পিছনে সরকারের সমর্থন রহিয়াছে। তাঁহাদের ‘লোভ’ এই বিশ্বাসের ভিতের উপরই দাঁড়াইয়া ছিল। এত বৎসর রাজ্যে-কেন্দ্রে বহু বর্ণের সরকার দেখিবার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও সরকারের উপর তাঁহাদের এমন অন্ধ আস্থা জন্মায় কী ভাবে, সে প্রশ্ন থাকুক। এই আস্থা বাস্তব। এখনও সাধারণ মানুষ সরকারকেই অভিভাবক জ্ঞান করেন। সেই ভরসার মান রক্ষা করিবার দায়িত্ব সরকার অস্বীকার করিতে পারে কি? সেই দায়িত্বের প্রেক্ষিতে দেখিলে পশ্চিমবঙ্গের ছবিটি ভয়াবহ। সত্য, সারদা গোষ্ঠীর কার্যকলাপে সরকারের প্রত্যক্ষ মদত রহিয়াছে, কাগজে-কলমে হয়তো তাহার কোনও প্রমাণ নাই। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস কাগুজে প্রমাণের অপেক্ষায় থাকে না। বর্তমান বিপর্যয়ে সেই সত্য আবারও জানা গেল।
সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কর্মকাণ্ডে রাজ্য সরকারের সমর্থন রহিয়াছে, এই কথাটি মানুষ বিশ্বাস করিয়াছিলেন কেন, তাহা বোঝা খুব কঠিন নয়। মন্ত্রী, সাংসদ হইতে শুরু করিয়া শাসক দলের বিবিধ নায়কনায়িকা ও প্রতিনিধিদের তাঁহারা ক্রমাগত এই গোষ্ঠীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকিতে দেখিয়াছেন। রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন, ‘কেহ যদি সারদা গোষ্ঠীর ক্ষতি করিবার চেষ্টা করে, তাহা হইলে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া আমরা সবাই দাঁড়াইব।... আমরা আছি।’ ‘আমরা’ বলিতে তিনি ঠিক কাহাদের কথা বলিয়াছিলেন, মন্ত্রিবর স্পষ্ট করেন নাই। মানুষ যাহা বুঝিবার, বুঝিয়াছে। শাসক দলের বা সেই দল সমর্থিত একাধিক সাংসদ এই গোষ্ঠীর সহিত নানা ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁহারা বলিতেই পারেন, সারদা গোষ্ঠী কী করে, তাহারা লোক ঠকায় কি না, সে বিষয়ে তাঁহাদের কাহারও কোনও ধারণা ছিল না। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু আরও গভীর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা দরকার। সংস্থাটি যেমনই হউক, যাহাই হউক, সরকারি প্রতিনিধিরা কোনও বেসরকারি সংস্থার প্রচার এবং পৃষ্ঠপোষকতা করিবেন কেন? বিশেষত তাঁহারা যখন জানেন যে সাধারণ মানুষের নিকট তাঁহাদের শংসাপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম, তখন তাঁহাদের সংযত থাকাই উচিত ছিল। তাঁহারা সেই সংযম অভ্যাস করেন নাই। কেন, সে প্রশ্নের উত্তর রাজ্যবাসী নিজেদের মতো করিয়া বুঝিয়া লইয়াছে।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরিয়াই চিট ফান্ডের বোধন হইয়াছে বলিলে অবশ্য আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অশুচি হইবে। সঞ্চয়িতা বা সঞ্চয়নী যখন এই রাজ্যে মানুষকে পথে বসাইতেছিল, তখন বামপন্থীরা সদাপট ক্ষমতায় ছিলেন। সেই অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন শাসকরা কিছুই জানিতেন না বলিলে বালকেও হাসিবে। বাম জমানার শেষ পর্যায়ে যখন গোটা দেশ জুড়িয়াই চিট ফান্ডের রমরমা হইতেছিল, পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম ছিল না। কাজেই, আজ সূর্যকান্ত মিশ্ররা যতখানি নিষ্পাপ সাজিতে ব্যগ্র, বাস্তব তাঁহাদের প্রতি ততখানি সদয় হইবে না। কিন্তু, দুই জমানাকে এক করিয়া দেখিবার উপায় নাই। তাহার প্রথম কারণ, যথার্থ নেতৃস্থানীয় কোনও বামপন্থী প্রকাশ্যে কোনও চিট ফান্ডকে ‘আমরা আছি’ গোত্রের মদত জোগান নাই। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী দাবি করিতেছেন, চিট ফান্ডের পাপটি বাম জমানার তাহা সাফ করিবার দায় তাঁহার ঘাড়ে পড়িয়াছে। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি তিনি এই অনিয়মের কথা মহাকরণে আসিবার লগ্নেই জানিতেন? তাহা হইলে গত দুই বৎসরে তিনি এই প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেন নাই কেন? এখন যে পদক্ষেপগুলি করিতেছেন, তাহার একটিও করেন নাই কেন? সত্য, যাঁহারা সর্বস্বান্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের উদ্ধার করিবার দায় রাজ্য সরকারের নাই। কিন্তু শাসক দলের নেতাদের দেখিয়া যখন মানুষ সর্বনাশের পথে চলিতে প্ররোচিত হন, তখন দায় ঝাড়িয়া ফেলিবার নৈতিক অধিকার আর থাকে কি? |