প্রবন্ধ ৩...
দারিদ্র কি কেবল ক্যালরি দিয়ে মাপা যায়
ভারতের রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ বৈষম্য নিয়ে আমরা আগের লেখায় আলোচনা করেছি। (‘নতুন মানব উন্নয়ন রিপোর্ট কোথায়’, ১০-৪) এ বার আলোচনা করতে চাই বিভিন্ন রাজ্যে দারিদ্রের হার নিয়ে। আলোচনাটাকে দুটি পর্বে ভাগ করব। প্রথম পর্বে আমরা দেখব, কী ভাবে দারিদ্র মাপা হয়। দ্বিতীয় পর্বে দেখব, বিভিন্ন রাজ্যে দারিদ্রের মাত্রা কী ভাবে পালটাচ্ছে এবং এখন সেই মাত্রার বিচারে কোন রাজ্য কোথায় দাঁড়িয়ে।
প্রথম কথা হল, দারিদ্র একটি বহুমাত্রিক ধারণা। আয় কিংবা ভোগব্যয়ের মতো কোনও একটা মাপকাঠি দিয়ে একটা পভার্টি লাইন বা ‘দারিদ্র সীমা’ দেগে দেওয়া হল এবং কারা সেই সীমার নীচে আছে (বিলো পভার্টি লাইন বা বি পি এল) আর কারা তার উপরে আছে (অ্যাবাভ পভার্টি লাইন বা এ পি এল) সবাইকে চিহ্নিত করে দারিদ্রকে পুরোপুরি মেপে ফেলা হল এমনটা হয় না, হতে পারে না। আয় বা ভোগব্যয় একটা মাপকাঠি মাত্র। শুধু ভারতে নয়, সব দেশেই এই মাপকাঠিগুলি বহু ব্যবহৃত, তার কারণ এই সব বিষয়ে তথ্য তুলনায় অনেক সহজে পাওয়া যায়।
দারিদ্রের গণনা যে সব দেশে প্রথম শুরু হয়, ভারত তাদের অন্যতম। সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই প্রধানত যোজনা কমিশনের পরিচালনায় এই বিষয়ে কাজ শুরু হয়। পরে, ১৯৭৯ সালে এবং তার পর ১৯৯৩ সালে দারিদ্র পরিমাপের পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন করা হয়। তবে যে মূল নীতি অনুসরণ করা হচ্ছিল, সেটা মোটামুটি এই রকম। প্রথমে ঠিক করা হয়, ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য কতটা ক্যালরি রোজ দরকার। গ্রামে এই মাত্রাটি ঠিক হয়েছিল ২৪০০, শহরে ২১০০। অর্থাৎ, প্রধান জোরটা দেওয়া হয়েছিল খাদ্যের উপর, যদিও বস্ত্রের প্রয়োজনও কিছুটা হিসেবে রাখা হয়। পঞ্চাশের দশকে এই ভাবনা অসঙ্গত ছিল না, কারণ তখন ধরে নেওয়া হত শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো প্রয়োজনগুলি সরকার মেটাবে।
প্রশ্ন হল, ভোগব্যয় অন্তত কতটা হলে, অন্যান্য জরুরি খরচ করার পরে, ওই ন্যূনতম ক্যালরির প্রয়োজন মিটতে পারে? এই ভাবেই একটা ন্যূনতম ভোগব্যয়ের অঙ্ক স্থির করা হয় এবং তার নাম দেওয়া হয় দারিদ্রসীমা। এই পদ্ধতিতে ক্যালরি-ভিত্তিক দারিদ্র সীমার ধারণা থেকে ব্যয়-ভিত্তিক দারিদ্রসীমা তৈরি করা হয়। এখানে কয়েকটা কথা খেয়াল রাখা দরকার।
এক, বাস্তবে কারও ভোগব্যয় ওই সীমার উপরে থাকলেই তিনি ওই পরিমাণ ক্যালরি ভোগ করবেন, এমনটা ধরে নেওয়া চলে না, টাকাটা তিনি অন্য ভাবেও খরচ করতে পারেন। কিন্তু দারিদ্রসীমা দিয়ে সামর্থ্যের একটা পরিমাপ করা হচ্ছে, সেটা প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।
দুই, বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য ও অন্য প্রয়োজন মেটানোর উপকরণগুলো কিছুটা আলাদা। তা ছাড়া, দামও সর্বত্র এক নয়। তাই ন্যূনতম ভোগব্যয় তথা দারিদ্রসীমার অঙ্ক এক এক রাজ্যে এক এক রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর প্রত্যেক রাজ্যেই গ্রাম আর শহরের দারিদ্রসীমাও আলাদা।
তিন, কালক্রমে জিনিসপত্রের দাম বদলায়। সুতরাং মূল্য সূচকের পরিবর্তন অনুসারে দারিদ্রসীমার অঙ্কটাও নিয়মিত বদলানো উচিত।
দারিদ্রসীমা নির্ধারণের পরে সেই সীমার নীচে কত মানুষ আছেন তার খোঁজ পড়ে। সে জন্য চাই তথ্য পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যা সংগ্রহ করা হয় সমীক্ষা চালিয়ে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (ন্যাশনাল সাম্পল সার্ভে বা এন এস এস) আয়ের হিসেব জোগাড় করে না, জোগাড় করে ভোগব্যয়ের হিসেব। তার কারণ, আয়ের চেয়ে ভোগব্যয়ের পরিসংখ্যান অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। এন এস এস সাধারণত দু’রকমের সমীক্ষা করে: বড় নমুনা এবং ছোট নমুনা। প্রথমটিতে অনেক বেশি মানুষের কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, দ্বিতীয়টিতে তুলনায় অনেক কম। স্বভাবতই প্রথমটি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। মুশকিল হল, এই বড় নমুনা সমীক্ষা করা হয় পাঁচ বছর অন্তর। তাই দারিদ্র বিষয়ক নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানও মেলে ওই পাঁচ বছর অন্তর। শেষ দুটি বড় সমীক্ষা হয়েছে ২০০৪-০৫ এবং ২০০৯-১০ সালে।
দুটো ছোট ব্যাপার। এক, পৃথিবীর সর্বত্রই পরিবারভিত্তিক সমীক্ষায় ভোগব্যয়ের যে হিসেব পাওয়া যায়, প্রকৃত ভোগব্যয় তার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে, ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। দুই, সমীক্ষায় কত দিনের আগের ব্যয়ের হিসেব চাওয়া হচ্ছে, তার উপর তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা অনেকটা নির্ভর করে, যত সাম্প্রতিক তথ্য চাওয়া হয় তত নির্ভুল হিসেব পাওয়া যায়।
যোজনা কমিশন যে ভাবে দারিদ্রের পরিমাপ করে এসেছে, তা নিয়ে সমালোচনা অনেক। ক্যালরির হিসেব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। তার একটা বড় কারণ, এ দেশে জীবনযাত্রার ধারা বিস্তর বদলেছে, এমনকী গ্রামেও। এখন আর শহরে কমপক্ষে ২৪০০ আর গ্রামে ২১০০ ক্যালরির প্রয়োজন হয় না। তার নানা কারণ আছে। একটা দৃষ্টান্ত হল, অনেক জায়গাতেই এখন আর মেয়েদের দশ কিলোমিটার হেঁটে জ্বালানি জোগাড় করতে হয় না, রান্নার গ্যাস বা অন্য ব্যবস্থা হয়েছে। সর্বত্র হয়নি, সকলের জন্য হয়নি, কিন্তু অনেকের হয়েছে। সুতরাং গড় হিসেবটা পালটানো দরকার।
এই সব প্রশ্নের মোকাবিলা করতে যোজনা কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করে। তেন্ডুলকর কমিটির সুপারিশের বিশদ আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই, মূল কথাটা ছিল এই যে, প্রধানত ক্যালরির হিসেব না কষে, শুধু খাদ্যের পরিমাণ বিচার না করে সরাসরি হিসেব করা দরকার, একটা মানুষের ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য কতটা খরচ করতে হয়। সেই অনুসারে দারিদ্রসীমার নতুন হিসেব কষেছিলেন এই কমিটি। তা ছাড়া, তেন্ডুলকর কমিটির পদ্ধতিতে জিনিসপত্রের দামও সমীক্ষা থেকেই নির্ণয় করা হয়, আলাদা মূল্য সূচক ব্যবহার করা হয় না। এই সূত্রে বলা দরকার, তেন্ডুলকর কমিটির সুপারিশ অনুসারে তৈরি করা দারিদ্রের পরিসংখ্যান যোজনা কমিশনের আগেকার পরিসংখ্যানের সঙ্গে ঠিক তুলনীয় নয়।
আমরা পরের পর্বে দেখব, বিভিন্ন রাজ্যে দারিদ্রসীমার নীচে কত শতাংশ মানুষ আছেন। এটাও দেখব যে, সাম্প্রতিক কালে এই অনুপাত বিভিন্ন রাজ্যে কী ভাবে পালটেছে।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.