বিজয় দেবনাথ থাকেন দিল্লিতে। সিউড়িতে আত্মীয়ের বাড়িতে ক’দিন থেকে দিল্লি ফেরার আগের দিন সন্ধ্যায় একটি মিষ্টির দোকান থেকে নানা ধরনের মোরব্বা কিনলেন তিন কিলোগ্রাম। “এটা একটা ক্লাসিক মিষ্টি,” বললেন তিনি। ওই দিনই সিউড়িতে কাজে আসা ঝাড়খেণ্ডের বাসিন্দা তোতন পাল ফেরার পথে ওই দোকান থেকেই তিনটি পদের দুই কিলোগ্রাম মোরব্বা কিনলেন। ওই দোকানের প্রধান কর্মী জানালেন, স্থানীয় খদ্দেরদের চাইতেও বিজয়, তোতনের মতো বেড়াতে-আসা মানুষদের কাছে মোরব্বার চাহিদা বেশি। অথচ আজও সিউড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে ‘সিউড়ির মোরব্বা’ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ে একটা জায়গা করে নিতে পারল না।
সিউড়ির মোরব্বা ব্যবসায়ী নন্দদুলাল দে চার পুরুষ এই কাজ করছেন। জানালেন, প্রতিদিন প্রায় দেড় কুইণ্টাল মোরব্বা বিক্রি হয় তাঁর দোকান থেকেই। সিউড়ি শহরেই মোরব্বার ছোট-বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন কয়েক ডজন। অধিকাংশই মিষ্টির দোকান থেকে বিক্রি করেন মোরব্বা। বাজার থেকে ফল, সবজি কিনে তাঁদের হালুইকররাই মোরব্বা তৈরি করছেন। কয়েকশো পরিবার মোরব্বার ব্যবসার উপর নির্ভরশীল।
তা হলে এই ব্যবসায়ীরা উৎপাদন বাড়াচ্ছেন না কেন? |
ফল থেকে সবজি মোরব্বায় হাজির সবই। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
এক বড় ব্যবসায়ীর কথায়, “শ্রমিক সংগঠনের হঠাৎ হঠাৎ ধর্মঘট ডাকে, তাই ব্যবসা বাড়ানোর চিন্তা করছি না।” নার্বাডের জেলা ম্যানেজার প্রশান্ত সাহা বলেন, “মোরব্বা স্থানীয়ভাবেই চলে। তাই নতুন কোনও ব্যবসায়ী মোরব্বার ব্যবসায় এগিয়ে আসে না।” সে কথাটা অবশ্য স্বীকার করলেন না বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সচিব দুর্গাপ্রসাদ নাগ। তিনি বলেন, “বেলের মোরব্বার চাহিদা কতখানি, সে তো ডালহৌসি চত্বরে ঘুরলেই বোঝা যায়। খোলাখুলি ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে মোরব্বা।”
মোরব্বার পুষ্টিগুণের সঙ্গে রয়েছে ওষধিগুণও। আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে মোরব্বার ব্যবহার রয়েছে। কথিত আছে, মোরব্বা শব্দটি এসেছে আরবী ‘মুরাব্বা’ থেকে। ১৭১৮ সালে রাজনগরের নবাব বদির উদ্জামাল লক্ষৌ, বেনারস ও আগ্রায় ওই মিষ্টির সন্ধান পেয়ে কারিগর দিয়ে প্রথমে বেল, চালকুমড়া ও শতমূলের মোরব্বা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে পটল, গাজর, হরিতকি, আমলা, পেপে প্রভৃতি ফল ও সব্জির মোরব্বারও প্রচলন হয়।
পুষ্টিগুণের সঙ্গে রয়েছে শিল্পগুণও। চিত্রকর যোগেন চৌধুরী সিউড়ির মোরব্বা কিনে খেয়েছেন শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা থেকে। তাঁর উপলব্ধি, “নানা রঙের ও আকারের মোরব্বার মধ্যে শিল্পের ছোঁয়া আছে।” ছানার মিষ্টির চাইতে মোরব্বা থাকেও বেশি দিন। বাড়তি ‘প্রিজার্ভেটিভ’ ছাড়াই টিনের পাত্রে দিন পনেরো ভাল থাকে, ফ্রিজে রাখলে আরও বেশি।
অথচ মোরব্বাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে উৎপাদন-বিপননের কাজটা বাকিই থেকে যাচ্ছে। জেলা কৃষি বিপণন (প্রশাসনিক) ও কৃষি বিপণন, সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণ আধিকারিক আকবর আলি জানান, তাঁদের দফতরে জ্যাম, জেলি, আচার তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও মোরব্বার বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদন বিষয়ে কোনও প্রস্তাব আসেনি। সমস্যা বিপনন নিয়েও। অধিকাংশ দোকানে যে ভাবে প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে মোরব্বা ভরে দেওয়া হয়, তা সুদৃশ্য নয়, নিরাপদও নয়। “অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তো বিদেশে আমের আচার রফতানি হচ্ছে। যথাযথ সংরক্ষণ, পরিচ্ছন্নতার শর্ত মানতে সেখানে যদি অসুবিধে না থাকে, মোরব্বাকে বাজারে ঠিকমতো পরিবেশন করতে অসুবিধে কোথায়?” বলেন দুর্গাপ্রসাদবাবু।
দার্জিলিং চা-এর মতো, ‘সিউড়ির মোরব্বা’-ও একটা ব্র্যান্ড নেম হয়ে উঠতে পারে, মনে করেন দুর্গাপ্রসাদবাবু। চাই কেবল কয়েকজন লড়াকু আঁতেপ্রেনিয়র। |