দিনের শেষে কোনও দিন হাতে থাকে ৫০ টাকা, কোনও দিন বা ৭০ টাকা। চায়ের দোকান থেকে সেই সামান্য লাভটুকুই রাতে বাড়ি ফিরে ‘দে কোম্পানি’-র এজেন্টের হাতে তুবে দিতেন সরস্বতী সরকার। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের দ্বিজহরি কলোনির বাসিন্দা সরস্বতী ১৭৫০ টাকা জমানোর পর চম্পট দিয়েছে আর্থিক সংস্থাটি।
কেন এমন সংস্থায় রাখলেন টাকা? সরস্বতী বলেন, ‘‘ঘুম থেকে উঠেই দোকানে যেতে হয়। দুপুরে এক ফাঁকে এসে রান্না করে খেয়ে-দেয়ে ফের দোকান। ফিরতে ফিরতে রাত। কখন ব্যাঙ্কে যাব? লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কিছু জিজ্ঞাসা করলে গালি খেতে হয়। এজেন্টরা সাইকেলে, মোটরবাইকে এসে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে যেত। অনেক সুবিধা ছিল।’’
ওই সংস্থায় টাকা রাখতেন সুমিতা বসুও। রাজমিস্ত্রীর স্বামীর রোজগার থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প জমিয়ে ১২ হাজার টাকা সংস্থাকে দিয়েছিলেন সুমিতা। পাশ বই দেখিয়ে বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কে কি রোজ ১০-২০ টাকা করে জমা দেওয়া যায়? আর, ব্যাঙ্কে বই করতেই তো হাজার টাকা লাগে। কোথায় পাব? তারপরে এই কাগজ, সেই কাগজ, এর থেকে প্রমাণপত্র, ওকে দিয়ে সই করিয়ে আনো, হাজারটা ঝক্কি। কে যাবে ব্যাঙ্কে?’’
দ্বিজহরিদাস কলোনির বাসিন্দারা বেশির ভাগ ভ্যানরিকশা চালক, দিনমজুর, কিংবা দোকানের কর্মী। মহিলারা জরির কাজ, পরিচারিকা বা দোকানে কাজ করেন। মেয়েরা জানান, অনেকে মদ্যপ স্বামীদের হাত থেকে টাকা বাঁচিয়ে তিলে তিলে সঞ্চয় করেছিল। টাকা চোট যাওয়ায় স্বামীর কাছেও লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে।
চড়া সুদের লোভ করেই বিপত্তি, এ কথা মানতে নারাজ সুমিতা। তাঁর কথায়, “রোজ ব্যাঙ্কে যাওয়া যায় না। আবার, গোটা মাস জমানোও যায় না টাকা। চুরির ভয়, বাড়িতে অসুখ-বিসুখ কিছু হলেই জমানো ভাঁড়ে হাত পড়ে। এজেন্টদের কাছে এককালীন টাকা রাখা, যখন যত ইচ্ছে টাকা রাখা যেত। বন্ধক না রেখে সহজে ঋণ পেতাম।’’ ওই পাড়ার দীপালি হালদার বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক বাবুদের জন্য। গরিব মানুষের জন্য এই কোম্পানিগুলোই ছিল।’’ ‘ডিলয়েট’ অর্থলগ্নি সংস্থার ডিরেক্টর পি আর প্রসাদও বলেন, কেবল বাড়তি সুদের প্রলোভনেই লোকে সারদার মতো সংস্থাগুলিতে টাকা রাখে, এমন ভাবলে ভুল হবে। এদের প্রকল্পে নমনীয়তা আসলে অনেক বেশি। “সামান্য অঙ্কের টাকাও জমা দেওয়া যায়। যখন ইচ্ছে টাকা তোলা যায়, ঋণ নিতে চাইলে কেন টাকা প্রয়োজন তার কৈফিয়ত বা প্রমাণ দিতে হয় না। আর অনেক বড় অঙ্কের টাকাও ধার নেওয়া চলে, কোনও কিছু বন্ধক না রেখেই,” বলেন প্রসাদ। “এই সংস্থাগুলোর যে উপযোগিতা রয়েছে, তা মানতেই হবে। এদের উঠিয়ে না দিয়ে, ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।”
গ্রামের মেয়েদের সঞ্চয়, রুজি-রোজগার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তরুণ দেবনাথ। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বললেন, “স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য রাজ্যের প্রায় ৯০ লক্ষ মেয়ে। গোষ্ঠীর অ্যাকাউন্ট আছে ব্যাঙ্কে। কিন্তু মাসে নির্দিষ্ট ৩০-৫০ টাকাই মেয়েরা জমাতে পারে। হাতে বাড়তি কয়েকশো টাকা এলে অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার সুযোগ নেই।” সম্প্রতি অবশ্য নাবার্ড স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অ্যাকাউন্টে এককালীন সঞ্চয়েরও সুযোগ দেবার কথাও বলছে। কিন্তু তা কাজে পরিণত হতে ঢের সময় লাগবে।
জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক জানান, এখন ঋণ ও বিনিয়োগ নিয়ে সমীক্ষা চলছে। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ঋণের সম্পর্ক অনেকটাই ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্ভর, যার মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতারও ভূমিকা রয়েছে। এজেন্টরা ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার কারণে সহজেই সেই সম্পর্কের জালে ঢুকে যায়। যার নামেই ঋণ তোলা হোক, যে সেই টাকা ব্যবহার করছে, তার কাছে গিয়েই তাগাদা দেয় এজেন্টরা। ব্যাঙ্ক এই পুরো ব্যবস্থাটার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। ভিতরে ঢুকতে পারছে না।”
তবে ব্যাঙ্কও বদলাচ্ছে। নিমপীঠের ‘বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ বায়োটেকনোলজি’-র সদস্যরা স্টেট ব্যাঙ্কের ‘বিজনেস করেসপন্ডেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। সাতটা ব্লকে প্রায় ১৮ হাজার গ্রাহক রয়েছে তাঁদের। সংস্থার তরফে দীপ্তি মিত্র জানালেন, ২৫-২৬ জন কর্মী নিয়মিত ল্যাপটপ নিয়ে চলে যান গ্রামে। বসেন পাড়ার ক্লাবে, গ্রাহকের ঘরেও। একজন গ্রাহক দিনে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন করতে পারেন। দীপ্তির কথায়, “গ্রামবাসীরা আগে দালালদের ৫০ টাকা করে দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতেন। এখন তা উঠেই গিয়েছে। সত্তর বছরের বৃদ্ধও গ্রামে বসে অ্যাকাউন্ট খুলছেন।” অনেকের টাকা মারা যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে, চিট ফান্ড থেকে মুখ ফেরাতে তাই সময় লাগেনি, বলেন দীপ্তি।
ব্যাঙ্ক, বিমা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের নানা প্রকল্প কত দ্রুত গ্রামের মানুষের কাছে আসবে, তার উপরেই নির্ভর করছে দরিদ্রের আর্থিক নিরাপত্তা। আইন করে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেও লাভ হবে না সুমিতা-সরস্বতীদের, যদি না নিরাপদ বিকল্প থাকে তাদের কাছে। |