মোরাম বিছানো সরু রাস্তার পাশে এবড়ো-খেবড়ো জমি। ওই তিন বিঘা জমিতে চাষ হয় না। জমিতে শুধু লম্বা ঘাস। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও মাঠের আশেপাশে কোনও মানুষের দেখা মেলে না পূর্বস্থলীর লক্ষ্মীপুরে।
মাঠ থেকে কিছুটা দূরে এক জায়গায় ক্রিকেট খেলা চলছে। ওই মাঠে খেলা হয় না কেন, এক কিশোরকে এই প্রশ্ন করতে উত্তর এল, “ওই যেখানে লম্বা লম্বা ঘাস গজিয়েছে, সেখানে বছর তিনেক আগেও ফুটবল, ক্রিকেট খেলা হত। কিন্তু মাঠ নিয়ে দু’পাড়ার মধ্যে গোলমাল হল। অনেকে মারাও গেল। তার পর থেকে আর ওই মাঠে খেলা হয় না। পড়ে থেকে থেকে গোলপোস্ট দু’টোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
লক্ষ্মীপুরের এই মাঠ নিয়ে গোলমালে ইতিমধ্যে প্রাণ গিয়েছে আট জনের। শেষ ঘটনা গত রবিবার রাতের। বাজারে বসে থাকার সময়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমায় মৃত্যু হয়েছে বলরাম দে নামে এলাকার এক বাসিন্দার। বাসিন্দাদের আক্ষেপ, যে মাঠ নিয়ে বিবাদের সূচনা হয়েছিল, সেখানে এখন আর খেলা হয় না। কিন্তু বিবাদের জের এখনও চলছে, প্রাণও যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা জানান, খেলাধুলো তো দূর, আবার কোনও অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে কেউ গরু-ছাগল পর্যন্ত চরাতে যান না ওই মাঠে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ার মধ্যে অশান্তির সূত্রপাত। লক্ষ্মীপুর ঘোষপাড়া ও আলুনির মাঠের বাসিন্দাদের এই বিবাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে দুষ্কৃতীরা। পুলিশ দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। পরপর সংঘর্ষ, প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গ্রামের এক যুবক এখনও নিখোঁজ। |
গোলমালের কেন্দ্রে এই মাঠ। —নিজস্ব চিত্র। |
পুলিশ জানায়, লক্ষ্মীপুরের এই সব ঘটনার তদন্তে নেমে বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে। লক্ষ্মীপুরের কাছাকাছি মিসবাপুর, বাবুইডাঙা, খড়দত্তপাড়া, হামিদপুর-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে দুষ্কৃতীদের ঘাঁটি রয়েছে। লক্ষ্মীপুরের দুষ্কৃতীরা ওই সব গ্রামের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে হাত মেলায়। বেআইনি ভাবে পোস্ত চাষ থেকে দুষ্কৃতীদের কাছে প্রচুর অর্থ আসত, এমনটাই দাবি পুলিশের।
পুলিশের দাবি, ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হয়। দুষ্কৃতীদের অস্ত্র বিক্রির এজেন্ট-সহ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের অভিযানে প্রচুর অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। সিআইডি-ও প্রচুর অস্ত্র পায় পূর্বস্থলী থেকে। টানা এক বছর নজরদারি চালিয়ে আরও কিছু দুষ্কৃতী ধরা পড়ে। পোস্ত চাষ বন্ধেও অভিযান হয়। এত কিছুর পরেও দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য থামানো যায়নি। দুই পাড়ার লড়াইয়ে আলুনির মাঠের লোকজনের পক্ষ নিয়ে ঘোষপাড়ার কিছু বাসিন্দার রোষে পড়ে কিছু বাসিন্দা। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মাঠের দখলকে কেন্দ্র করে লড়াইয়ের পরেই ওই বাসিন্দাদের কয়েক জন এলাকাছাড়া হয়। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ খুন হন পূর্ণ ঘোষ নামে এক ব্যক্তি।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৮-৯ মাস ধরে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে এলাকাছাড়া বাসিন্দারা। রবিবার বিকেলে পালিয়ে বেড়ানো দুষ্কৃতীরাই ফের গোলমাল পাকায়। স্থানীয় সূত্রে পুলিশ জেনেছে, নিহত পূর্ণবাবুর ভাইপো বাপি ঘোষ ওই দুষ্কৃতীদের ঘরে ফেরার ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। বাপিবাবুর বিরুদ্ধেও এলাকায় নানা দুষ্কর্মের অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে লক্ষ করেই রবিবার সন্ধ্যায় বাজারে বোমা ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। পায়ে আঘাত পেলেও প্রাণে বেঁচে যান বাপিবাবু। কিন্তু বোমা ফেটে মৃত্যু হয় বলরামবাবুর।
এলাকার অনেক বাসিন্দারই দাবি, তাঁরা চান এলাকা দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হোক, শান্তি ফিরে আসুক। বলরামবাবুর আত্মীয় অমিত দে-র কথায়, “দুষ্কৃতীদের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের এ ভাবে প্রাণ যাবে, আমরা মেনে নিতে পারছি না। প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই আবেদন, এলাকায় শান্তি ফেরানো হোক।” পূর্বস্থলীর (উত্তর) তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় জানান, বাসিন্দারা এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি চাইছেন। সে ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুরে বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রশাসনিক কর্তারা। ছিলেন বিধায়ক তপনবাবু, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার। তাঁদের কাছে গ্রামবাসীরা দুষ্কৃতীদের ধরার দাবি জানান। দ্রুত সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দেওয়া হয়।
আশ্বাস মিলছে। কিন্তু শান্তি কবে ফিরবে, তা-ই এখন লক্ষ্মীপুরের মানুষের বড় প্রশ্ন। |