হাড় জিরজিরে রোশেনারা কেবলই ভোগে। জ্বর আর পেটের অসুখ নিত্য সঙ্গী দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার এই মেয়ের। ভুগে ভুগে মেয়েটা তেমন বাড়েও না। ১২ বছরের রোশেনারার উচ্চতা পাঁচ বছরের শিশুর মতো।
পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের টাপু হালদারকে দেখেও যে কারও বামন বলে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। ১১-র টাপু ছ’-সাত বছরেও যা ছিল, এখনও তাই। বাবা-মা ভাবেন, এ একরকম ভালই হয়েছে। পেটের ভাত জোগাড় করতেই কালঘাম ছুটে যায়, ফি বছর নতুন জামাকাপড় জুটবে কোথা থেকে? তার চেয়ে একই জামা টানা কয়েক বছর পরা গেলে মন্দ কী? |
কলকাতার তপসিয়ার মানিক আলির অবস্থাও এর চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কিলোমিটারের হিসেবে দূরত্ব বিস্তর হলেও এই তিনজনের বড় হওয়ার গল্পটা কম-বেশি একই। দারিদ্র তো রয়েছেই। পাশাপাশি রয়েছে নিত্যদিনের আবশ্যিক কিছু পরিকাঠামোর অভাব, যার জের বহন করছে এই তিন শিশু ও তাদের মতো আরও অনেকে। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের মতে, এই পরিকাঠামোগুলির মধ্যে প্রধান হল স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। যা না থাকায় বহু মানুষই খোলা জায়গাতেই প্রাতঃকৃত্য সারেন। আর এই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস শৈশব থেকেই ঠেলে দেয় এক রুগ্ণ জীবনের দিকে, যার অন্যতম হল উচ্চতা না বাড়া।
নিছক অনুমান নয়, এই মতামতের কিছু তথ্যগত ভিত্তিও রয়েছে। কিছু দিন আগে ভারতবষের্র গ্রামগঞ্জে সমীক্ষা চালিয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তার ভিত্তিতে তারা যে স্বাস্থ্য-রিপোর্ট প্রস্তুত করে তার অন্যতম প্রধান দিকও ছিল এই পরিকাঠামোর অভাবের সমস্যা। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গভীর অপুষ্টি তো একটা বড় অংশ বটেই। পাশাপাশি যে শিশুরা খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, তাদের বাড়বৃদ্ধি কম। পাশাপাশি ওই একই বয়সের, একই আর্থিক অবস্থার যে শিশুরা শৌচাগার ব্যবহার করে, তুলনামূলকভাবে তাদের দেহের বৃদ্ধি বেশি। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্টেও সামনে এসেছে এই একই তথ্য। ইউনিসেফ-এর রিপোর্টও বলছে, খোলা জায়গায় মলত্যাগ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যহানির কারণ, উচ্চতা যার একটি।
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের ব্যাখ্যায়, যোগসূত্রটা সরাসরি না, খানিকটা ঘুর পথে। তিনি বলেন, “অপুষ্টির কারণে উচ্চতা বাড়ে না, এটা সবাই জানে। নেপালিদের দেখুন। নেপালি রাজ-পরিবারে সবাই কিন্তু লম্বা। অথচ আমরা যে নেপালিদের সচরাচর দেখে অভ্যস্ত, তারা অধিকাংশই বেঁটে। কারণ তারা গরিব, আর তারই ছাপ তাদের খাদ্য তালিকায়, তাদের শরীরে।” আর দারিদ্র এবং অপুষ্টির সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের যোগ তো রয়েছেই। অপূর্ববাবু বলেন, “খোলা জায়গায় মলত্যাগের ফলে হুক ওয়ার্ম অ্যানিমিয়া কিংবা অন্য ধরনের সংক্রমণ হয়। মাটি থেকে কৃমির ডিম সরাসরি শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। যার জেরে উচ্চতা, ওজন কোনওটাই বাড়ে না।”
একই অভিমত শিশু চিকিৎসক সুব্রত চক্রবর্তীর। তাঁর কথায়, “সহজভাবে বোঝাতে গেলে খোলা জায়গায় মলত্যাগ করলে বা মলত্যাগের পরে ভালভাবে হাত না ধুলে শরীরের একাধিক জটিল সংক্রমণ ঘটতে পারে। নানা ধরনের কৃমিও হাত, পায়ের পাতা বা মুখের মাধ্যমে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে। এ থেকে গোটা শরীরই রোগগ্রস্ত হয়। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে উচ্চতার উপরে।”
রাজ্য গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের কর্তারা জানিয়েছেন, কোনও শিশু নিজে শৌচাগার ব্যবহার করলেও তার উচ্চতা বৃদ্ধি আটকে যেতে পারে নানা কারণে। তার মধ্যে একটা হল তার আশপাশে যদি কোনও শিশু খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। একে বলে ‘নিয়ারবাই ডেফিকেশন’। সর্বশেষ জনগণনা রিপোর্টে ধরা পড়েছে এখনও দেশে ৪৯.৮ শতাংশ মানুষ খোলা আকাশের নীচে প্রাকৃতিক কাজকর্ম করেন, অথচ ৬৩ শতাংশ মানুষের বাড়িতে টেলিফোন সংযোগ রয়েছে, ৫৩ শতাংশের রয়েছে মোবাইল।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে নির্মল গ্রাম পুরস্কার চালু হয়েছে কয়েক বছর আগেই। কাকে বলে নির্মল গ্রাম? যেখানে একজন মানুষও খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য করেন না। যেখানে প্রত্যেক বাড়ি, স্কুল, অঙ্গনওয়াড়িতে শৌচাগার থাকে। সরকারি তরফে দাবি, এ রাজ্যে নির্মল গ্রাম পুরস্কার চালু হওয়ার পরে যে ব্লকগুলি পুরস্কৃত হয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে নজরকাড়া পরিবর্তন এসেছে। যেমন ৪০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, জলবাহিত রোগের আক্রমণ কমেছে। ২০ শতাংশ মানুষ স্বীকার করেছেন। তাঁদের সন্তানের স্কুল যাওয়া অনেক নিয়মিত হয়েছে। কিন্তু ছবিটা পুরোটাই এমন সদর্থক নয়। গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্যকর্তারাই আবার এ কথাও স্বীকার করেছেন, এমন বহু গ্রামেই তাঁরা গিয়েছেন যেখানে যাঁদের বাড়িতে শৌচাগার রয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশ সেটিকে শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ প্রশাসনের তরফে সেখানে শৌচাগার তৈরি হয়েছে সংখ্যাতত্ত্বের খেলায় এগিয়ে থাকার জন্য, অভ্যাস বদলের জন্য নয়। কোথাও ভাঙাচোরা টালি, কোথাও আবার প্যানটাই ব্যবহারের উপযুক্ত নয়, কোথাও আগাছা পরিষ্কার না করেই একটা ঘেরা জায়গা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও শৌচাগার তৈরির ব্যাপারে অনাগ্রহ এখনও কাটানো যায়নি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা মনে করেন, তাঁরা তো চেষ্টা চালাচ্ছেনই, পাশাপাশি সরকারি তরফেও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী অবশ্য দাবি করেছেন, সরকারি তরফে নিয়মিত প্রয়াস চলছে। আর তার ফলও মিলছে হাতেনাতে। তাঁর কথায়, “আর দু’এক বছরের মধ্যে সাফল্যের ছবিটা আরও স্পষ্ট হবে।”
রোশেনারা, টাপু, মাণিকের পরবর্তীরা সেই সাফল্যের আলো থেকে কত দূর, কে জানে! |