হাতে উপযুক্ত আইনি অস্ত্র নেই। তাই ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির দৌরাত্ম্য ঠেকাতে রাজ্য সরকার বিশেষ কিছু করে উঠতে পারে না। এই যুক্তিতে সহমত শাসক-বিরোধী, দু’পক্ষই। কিন্তু অন্য রাজ্যে কার্যকর হয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গে এই সংক্রান্ত আইন কেন চালু হয়নি, তা নিয়ে দুই শিবিরের দ্বৈরথ চরমে উঠল!
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা (চালু লব্জে চিট ফান্ড) নিয়ন্ত্রণে আইনের অভাবের জন্য বিগত বাম সরকারকেই কয়েক দিন ধরে দুষে আসছেন তৃণমূল নেতারা। সোমবার প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে। বামেদের ঘাড়ে যাবতীয় দোষ চাপিয়ে তিনিও বলেছেন, মাত্র তিন মাস আগে সেবি-র চিঠি পেয়ে রাজ্য সরকার বাম আমলের আইন খুলে দেখেছে, তাতে প্রচুর খামতি রয়েছে। এখন আরও শক্তিশালী করে ওই আইন তৈরি করতে চাইছে বর্তমান সরকার। তার আগে প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারির কথাও ভাবা হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম অভিযোগ, “ওই আইনে (বাম আমলের বিল) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা ছিল না। জনগণের টাকা রক্ষা করতে কড়া আইনের খসড়া তৈরি করে রেখেছি। কেন্দ্রীয় সরকার সাহায্য করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই আইন প্রণয়ন করব!” কিন্তু ঘটনা হল, ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর বিধানসভায় পাশ হওয়া ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অফ ডিপোজিটর্স ইন্টারেস্ট ইন ফিনান্সিয়াল এসট্যাব্লিশমেন্ট বিল’-এর ৫ নম্বর ধারায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সংস্থান আছে। পাশাপাশি, বিলের ৩ নম্বর ধারায় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে সংস্থার আধিকারিকদের কড়া শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
(বিলের প্রতিলিপি দেখুন)
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত রবিবারই জানান, ২০০৩ সালে যে বিল পাশ হয়েছিল, তাতে সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। তার পর কেন্দ্রের সুপারিশ মেনে ২০০৯ সালে তা বাড়িয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। মহাকরণের এক পদস্থ আধিকারিকের মতে, ২০০৯ সালে পাশ হওয়া ওই বিল কার্যকর করলেই ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এই ধরনের আইন করেই ওই সংস্থাগুলির উপরে রাশ টানতে সমর্থ হয়েছে তামিলনাড়ু। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের অভিযোগের পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “বিলটা উনি পড়েও দেখেননি!”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “২০০৩ সালে পূর্ববর্তী সরকার আইন পাশ করে কেন্দ্রকে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিল। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি চিঠি লিখে জানান, ওই বিলে খামতি রয়েছে। নতুন আইন তৈরি করো। কিন্তু তার পরেও বামফ্রন্ট ওই আইন ফেরত নেয়নি। পুরনো আইন তুলে না-নিয়ে নতুন করে আইন করা যায় না। কিন্তু আগের আইন তুলে না-নিয়েই ২০০৮ সালে আবার আইন তৈরি করা হয়। ২০০৯ সালে ফের সেই আইন কেন্দ্রের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল।”
সূর্যবাবু অবশ্য বলছেন, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতির চিঠির কোনও তথ্য কোথাও নেই। কেন্দ্রের জবাব এসেছিল ২০০৮ সালে। যার পর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ফের বিল পাশ করা হয়। বিরোধী দলনেতার দাবি, ২০০৯-এর বিলটিকে নতুন বলে ধরা হবে, না বকেয়া বিল হিসেবে ধরা হবে, তা নিয়ে বিধানসভার স্থায়ী কমিটিতে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছিল। সেই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তৃণমূলের শিশির অধিকারী। শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালের বিলের সংশোধনী হিসেবেই ২০০৯ সালের বিলটি পাশ করানো হয়। কারণ, “বিধানসভার কার্যবিধির ১১৫(২) ধারায় বলা আছে, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে কোনও বিল ফেরত (রিটার্ন) এলে সংবিধানের ২০০ ও ২০১ ধারা মতে তাকে বকেয়া (পেন্ডিং) বিল হিসেবেই ধরতে হবে।” ফলে পুরনো বিল ফেরতের অবকাশই ছিল না বলে সূর্যবাবুর অভিমত।
মুখ্যমন্ত্রী বাম আমলের বিল ফেরত নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তাঁর আমলেই বিল ফেরতের ব্যাপারে জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, তিন মাস আগে সেবি-র চিঠি পাওয়ার পরে বামফ্রন্টের তৈরি আইনটি ফেরত পাঠানোর জন্য কেন্দ্রকে তিনি অনুরোধ করেছেন। তাঁর কথায়, “কেন্দ্র তাড়াতাড়ি ফেরত দিলে কড়া আইন করতে পারি। ভুল আইনের জন্যই তো এই সব সংস্থাগুলির এত রমরমা! গত কাল রাষ্ট্রপতি আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে ফোন করেছিলেন। তাঁকেও আমি বলেছি, আইনটি দ্রুত ফেরত পাঠাতে।”
মহাকরণের এক কর্তা জানান, বিল ফেরত (রিটার্ন) এবং প্রত্যাহারের (উইথড্রয়াল) মধ্যে আইনগত ফারাক আছে। বিল ফেরত চাওয়ার অর্থ হল, ওই বিলেই কিছু সংশোধন করা হবে। কিন্তু নতুন বিল আনতে হলে আগের বিল প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী রাজ্যপালকে চিঠি লিখে বাম আমলের বিলটি ফেরানোর আর্জি জানান (রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য যাওয়া কোনও বিল ফেরাতে হলে রাজ্যপালকে দিয়েই আর্জি জানাতে হয়)। মহাকরণের ওই কর্তার কথা, “এর পরে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে চিঠি দিয়ে বলা হয় রাজ্য যদি নতুন বিল আনতে চায়, তা হলে আগের বিলটি প্রত্যাহার করতে হবে। সেই চিঠি রাজভবন মারফত গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে এসেছে।”
দ্রুত আইন বা অর্ডিন্যান্স করার যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্নে তুলেছেন বিরোধীরাও। সূর্যবাবুর বক্তব্য, “২০০৯-এ পাশ হয়ে যাওয়ার পরে বিলটা এত দিন দিল্লিতে পড়ে থাকল। মাঝে এত দিন কেন্দ্রের মন্ত্রী ছিলেন উনি। রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করতে পারতেন বিলে সম্মতির জন্য। আর যদি মনে করতেন বিলটা আগাগোড়াই ভুল, তা হলে নতুন করে বিল পাশ করাতে পারতেন বিধানসভায়। এত দিন অপেক্ষা করছিলেন কেন?”
বস্তুত, বাম ও কংগ্রেসের অভিযোগ, বিল-অর্ডিন্যান্সে অহেতুক মানুষকে বিভ্রান্ত করে সারদা-কাণ্ডের মূল পাণ্ডাদের গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগে অভিযুক্তদের গ্রেফতার এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করে পরে বিল নিয়ে বিতর্ক করা যেত বলে বিরোধীদের মত। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর কথায়, “আমরা সব ধরনের অর্ডিন্যান্সের বিরোধী। বর্তমান আইনেই এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। অর্ডিন্যান্সের কথা বলে কালক্ষেপ করা হচ্ছে, যাতে ওই সংস্থার কর্ণধার পালিয়ে যেতে পারেন।”
সারদা-কাণ্ড ঘিরে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির মোকাবিলার পথ খুঁজতে কংগ্রেস অবিলম্বে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছে। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, “লক্ষ লক্ষ আমানতকারীর স্বার্থরক্ষাই এখন প্রধান লক্ষ্য। এজেন্টদের নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচানোর পথ বার করতে বিধানসভায় আলোচনা দরকার।” |