আইন আইনের পথে চলিবে, এই বাক্যটি অতিব্যবহৃত লব্জে পরিণত হইয়াছে। আইন সচরাচর আইনের পথে চলে না বলিয়াই যে এমন বাণী বারংবার উচ্চারণ করিতে হয়, তাহাও স্পষ্ট। কিন্তু আইনের পথটিই যদি অস্পষ্ট হয়, তাহা হইলে? তথাকথিত চিট ফান্ড লইয়া যে সঙ্কট উত্তরোত্তর পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করিতেছে, তাহার পিছনে আইনের ঘাটতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যে বিপুল অনিয়ম দীর্ঘ দিন ধরিয়া পুঞ্জীভূত হইয়া এই বিপদ সৃষ্টি করিয়াছে, অসততা নিশ্চয়ই তাহার প্রধান ইন্ধন। কিন্তু আইন যথেষ্ট কঠোর হইলে সেই ইন্ধন এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি করিতে পারিত না। এই ধরনের কারবার নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং তাহার অনিয়মের দ্রুত প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় আইন কেন তৈয়ারি হয় নাই, তাহা লইয়াও পশ্চিমবঙ্গের অবধারিত পরম্পরা মানিয়া পারস্পরিক দোষারোপ চলিতেছে। এক দিকে রাজ্যের বর্তমান সরকার বনাম ভূতপূর্ব সরকার, অন্য দিকে রাজ্য বনাম কেন্দ্র— বিবাদের সুর দোতারায় বাজিতেছে। কিন্তু সেই তরজা শুনিয়া রাজ্যবাসীর কোনও সুবিধা নাই। তাঁহারা জানিতে চাহিবেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যের যৌথ তত্পরতায় এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন কেন বহু কাল আগেই প্রণীত এবং বলবত্ হয় নাই? লক্ষণীয়, লগ্নির বাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি কয়েক মাস আগে স্পষ্ট জানাইয়াছিল, উপযুক্ত আইনের অভাবেই তাহার পক্ষে চিট ফান্ডের অনাচার রোধ করা কঠিন হইতেছে।
উপযুক্ত আইন বলিতে ঠিক কী বোঝায়, তাহার বিশদ আলোচনার স্থান ইহা নহে। কিন্তু আইনের মূল নীতি কী হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে কোনও দ্বিমত থাকিতে পারে না। যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি জনসাধারণের অর্থ আমানত হিসাবে গ্রহণ করে, তবে সেই অর্থ তাহারা কোথায় কী ভাবে বিনিয়োগ করিতেছে তাহার উপর সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি এবং সেই শর্ত মানিয়া চলিবার বিষয়ে কঠোর তদারকি জরুরি। এই ধরনের সংস্থার অধিকাংশ লগ্নিই হওয়া দরকার ‘নিরাপদ’ ঋণপত্রে বা অন্য ধরনের ভাণ্ডারে, যাহাতে ঝুঁকি কম। স্বভাবতই, তেমন বিনিয়োগ হইতে অস্বাভাবিক কোনও আয় পাওয়া যাইবে না। কিন্তু অস্বাভাবিক আয় এবং তাহার সহগামী অস্বাভাবিক ঝুঁকির ব্যবসা অন্য, যেমন শেয়ার বাজার। জনসাধারণের নিকট আমানত সংগ্রহ করিয়া তেমন বাজারে খেলা চলে না, চলিতে পারে না। এ দেশে বিবিধ কেলেঙ্কারি হইতে শিক্ষা লইয়া কিছু কিছু লগ্নির বাজারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি হইয়াছে, কিছু কিছু সংস্থা সেই নিয়ন্ত্রণের শর্ত মানিয়া নিজেদের কারবার সংশোধন করিয়া সুস্থিত হইয়াছে। কিন্তু আইনে এখনও অনেক ফাঁকফোকর, বিশেষত চিট ফান্ডের ক্ষেত্রে। সেই সব রন্ধ্রে কী পরিমাণ বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত এবং লালিত হইয়াছে, আপাতত তাহাই দৃশ্যমান।
বিষবৃক্ষের বৃদ্ধিতে যে বস্তুটি সার হিসাবে কাজ করিয়াছে, তাহার নাম লোভ। পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় অগণিত মানুষ গত কয়েক দিনে সর্বস্বান্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের পরিণতি অত্যন্ত দুঃখজনক, অনেক ক্ষেত্রেই মর্মান্তিক। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই যে, তাঁহারা চিট ফান্ডে যে ভাবে টাকা ঢালিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ অবিবেচনার পরিচায়ক। ‘পনজি স্কিম’-এর ভয়াবহ পরিণতি নূতন নহে। এই রাজ্যে তো নয়ই ‘সঞ্চয়িতা’ মাত্র একটি দৃষ্টান্ত। তদুপরি, যে ধরনের চড়া সুদের প্রলোভন দেখাইয়া এই সব আমানত সংগ্রহ করা হইয়াছে, তাহা এতটাই অস্বাভাবিক যে কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে কেহ সেই প্রলোভনে পা বাড়ায় না। ‘আমি জানিতাম না’ বা ‘বুঝিতে পারি নাই’ বলিলে আদালত শোনে না, ন্যায়বোধও মানে না। যত দুঃখজনকই হউক, এমন অবিবেচনার এই পরিণতি, আজ না হউক কাল, রোধ করা দুঃসাধ্য ছিল। এখন যে সরকারকে ‘জনস্বার্থে’ হস্তক্ষেপ করিবার জন্য আর্জি জানানো হইতেছে, তাহাও অযৌক্তিক। অবিবেচনাকে রক্ষাকবচ দিতে কোষাগারের টাকা খরচের কোনও নৈতিক অধিকার সরকারের নাই। কথাটি কঠোর, কিন্তু সত্য। লোভের পরিণাম সম্বন্ধে শাস্ত্রে এবং প্রবচনে সেই আদিকাল হইতে বিবিধ সতর্কবাণী উচ্চারিত হইয়া আসিতেছে। তবু লোভ দুর্মর। |