তৃণমূলের নিশানায় বামই
সিবিআই চান অসীম, সায় কংগ্রেসেরও
সারদা-কাণ্ডে শাসক দলের উপরে চাপ আরও বাড়াল বিরোধীরা। দাবি উঠল সিবিআই তদন্তেরও।
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির (চালু লব্জে চিট ফান্ড) রমরমার দায় বামেদেরই বলে দাবি করে সারদা-কাণ্ডে তাদের দিকে ওঠা অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া তৃণমূল। বামেদের তরফে আসরে নেমে রবিবার রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত আবার প্রশ্ন ফিরিয়ে দিয়েছেন বর্তমান শাসকদের দিকেই। তাঁর বক্তব্য, এই ধরনের আর্থিক সংস্থাগুলির অনুমোদন কোনও ভাবেই রাজ্য সরকার দিতে পারে না। সংস্থাগুলির নথিভুক্তি করে কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প বিষয়ক মন্ত্রকের অধীন কোম্পানি নিবন্ধক। সারদা-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে অসীমবাবু বলেন, “এই ক্ষেত্রে কোম্পানি নিবন্ধক যুক্ত, সেবি যুক্ত, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যুক্ত। কেন্দ্রীয় সরকারেরও এগিয়ে আসা উচিত। তদন্তে সেবি-কে যুক্ত করবে কি না, কেন্দ্রের দেখা উচিত। কেন্দ্রীয় সরকার দরকারে সিবিআইকে কাজে লাগাক। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করুক। সম্পত্তি আটক করা হোক।”
সারদা সংস্থার সঙ্গে শাসক তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অসীমবাবু এ দিন আরও বলেন, “রাজনৈতিক কোনও দল বা নেতা কি টাকা পেয়েছে? ওই সংস্থা সংবাদমাধ্যম খুলেছিলই বা কোন উদ্দেশ্যে?” প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর আশঙ্কা, অভিযুক্ত সংস্থার কর্ণধারকে গ্রেফতার করতে যত দেরি হবে, সম্পত্তি হাতবদলের চেষ্টা হয়ে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনা তত অনিশ্চিত হবে। এই ধরনের সংস্থা নিয়ন্ত্রণে বাম আমলে পাশ-হওয়া বিলটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তৎপর না-হয়ে নতুন বিল তৈরির কথা বলে রাজ্য কেন সময় নষ্ট করছে, সেই প্রশ্নও এ দিন তুলেছেন অসীমবাবু।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর এই সব প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের তরফে বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন পাল্টা বলেন, “অসীম দাশগুপ্ত আজ এত বড় বড় কথা বলছেন! তাঁদের আমলে চিট ফান্ডের রমরমার বিরুদ্ধে অনেক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলছেন। তা হলে শাসক দল থাকার সময় এবং এখন বিরোধী দল হিসেবে সিপিএমের দলীয় মুখপত্র চিট ফান্ডের বিজ্ঞাপন নেয় কী ভাবে? তা হলে আর কোন অধিকারে অসীমবাবু এ সব কথা বলছেন?” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের আবার অভিযোগ, “সিপিএম দলটাই ১৯৮০ সাল থেকে চিট ফান্ড চালাত। সেই টাকাতেই বাংলা, কেরল, ত্রিপুরায় সিপিএমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হয়েছে। অসীমবাবু এত বড় বড় কথা বলছেন! ২০০৮ সালে তো তিনিই অর্থমন্ত্রী ছিলেন! ব্যবস্থা নেননি কেন? আসলে সিপিএমেরই যোগসাজশ ছিল ওই ধরনের সংস্থার সঙ্গে!”

সাংবাদিক বৈঠকে অসীম দাশগুপ্ত। আলিমুদ্দিনে।—নিজস্ব চিত্র
মুকুলবাবুদের যাবতীয় আত্মপক্ষ সমর্থনেও তাঁদের দিকে অভিযোগ ওঠা কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরী যেমন তির্যক মন্তব্য করেছেন, “রাজ্য সরকার ও চিট ফান্ডের মালিক চোরে চোরে মাসতুতো ভাই!” ভুঁইফোঁড় সংস্থার সঙ্গে তৃণমূল ও সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক ছিল কি না, তা নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবিও তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। আর সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে অধীরবাবুর প্রশ্ন, “মুখ্যমন্ত্রীর ছবি এক কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন সুদীপ্ত। তখন মুখ্যমন্ত্রী কেন চুপ ছিলেন?”
ছবি-প্রসঙ্গে তৃণমূলের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন সুব্রতবাবুই। তাঁর জবাব, “মুখ্যমন্ত্রীর ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। এর মধ্যে গোপনীয়তা কিছু নেই। প্রদর্শনীতে কে ছবি কিনবে, কে কিনবে না, সবই ক্রেতাদের ব্যাপার। এতে মুখ্যমন্ত্রীর কী করার আছে?” সিপিএম নেতারা গোড়া থেকেই দাবি করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কারা বিপুল টাকা দিয়ে কিনছেন, স্বচ্ছতা দেখাতে চাইলে তাঁদের নাম প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হোক। সে ঘোষণা অবশ্য এখনও হয়নি।
বিরোধীদের অভিযোগ, তৃণমূল এবং বর্তমান রাজ্য সরকারের সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর যোগসাজশের দৃশ্য বহু বার সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “তৃণমূলকে ভাল করে ধরতে পারলে প্রতারিত আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন!” মুকুলবাবুর পাল্টা দাবি, তৃণমূলের কেউ ওই সংস্থার সঙ্গে জড়িত নন। তবে তাঁদের কেউ জড়িত বলে প্রমাণিত হলে সরকার রাজধর্ম পালনে কার্পণ্য করবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় দু’বছরে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার প্রতারণা ঠেকাতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র কি কোনও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? বস্তুত, অর্থ দফতর কেন আরও সক্রিয় হচ্ছে না, তা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে তৃণমূলের অন্দরেই একাধিক বার প্রশ্ন উঠেছে। দিল্লিতে নিগ্রহের ঘটনার পর থেকে অমিতবাবু অন্তরীণ। যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। জবাবে মুকুলবাবু এ দিন বলেছেন, “অর্থমন্ত্রী কোনও পদক্ষেপ করেছেন কি না, তা সরকার বলবে। তবে দল সরকার চালায় না। তাই দলে এ নিয়ে প্রশ্ন বা আলোচনার ব্যাপার নেই।”
কলকাতায় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে এ দিন দলীয় সমাবেশে মুকুলবাবু, পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সাংসদ ও দলের যুব সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী সকলেই এক সুরে অভিযোগ করেন, “বাম আমলে ব্যাঙের ছাতার মতো চিট ফান্ড গজিয়েছে। তাদের রক্ষক ছিল বাম সরকার। জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মহাকরণ থেকে চিট ফান্ডের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা কখনও বলেননি। এখন কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।”
পার্থবাবুরা এমন কথা বললেও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তবু উঠছেই। কুলটির নিয়ামতপুরে এ দিন দলের এক জনসভায় সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেনের অভিযোগ, “রাজ্যের শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ছবি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে অর্থ তুলেছে চিট ফান্ড সংস্থাগুলি। আমানতকারীরা প্রতারিত হয়ে ওই নেতা-মন্ত্রীদের কাছে সাহায্যের আবেদন করায় তাঁরা এখন দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন!”
সিপিএম পলিটব্যুরোর আর এক সদস্য তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন কোচবিহারে বলেন, “ওই ভুইঁফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার প্রধান সিবিআইকে ১৮ পাতার চিঠি দিয়েছেন। তাতে ১২টি চিঠি সংযোজিত হয়েছে। সেগুলি প্রকাশ হওয়া দরকার। তাতে সব কিছু স্পষ্ট হবে!” সারদা-প্রধান সুদীপ্তবাবু গ্রেফতার হয়েছেন বলে তাঁর সন্দেহের কথাও জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, “মুখ্যমন্ত্রী কোন কাগজের উদ্বোধনে ছিলেন? জঙ্গলমহলে দেওয়া অ্যাম্বুল্যান্সগুলি কোথায় গেল? সব ছবি আছে। ভিডিও ফুটেজ আছে!”
শিলিগুড়িতে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “সারদা গোষ্ঠীর আমানতকারীদের সব টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে। ওই গোষ্ঠীর কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কোন নেতা-মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা ছিল, তা-ও খুঁজে বার করতে হবে।” এর পরেই অশোকবাবুর প্রশ্ন, “সারদা গোষ্ঠীর আমানতকারীরা সেবক রোডে অবরোধ করতেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসানো হল কেন? মন্ত্রীর যদি সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ না-থাকে, তা হলে তাঁর বাড়ির সামনে গোলমালের আশঙ্কা করা হল কেন?” প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর মন্তব্য, “বাম আমল ‘রাম-আমল’ ছিল না! তখনও দুর্নীতি ছিল। গুণ্ডা, অপরাধী, এ ধরনের কিছু ভুঁইফোঁড় সংস্থা ছিল। কিন্তু আমাদের কোনও নেতা, মন্ত্রী এ সবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন অভিযোগ নেই।”
অশোকবাবু অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তিনি সব পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে পাল্টা জানিয়ে গৌতমবাবু বলেন, “তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন সারদা গোষ্ঠীর কাজের সঙ্গে কোনও ভাবে আমি যুক্ত, তা হলে আমি সব ছেড়ে দেব! আর প্রমাণ করতে না-পারলে অশোকবাবুকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। এ ধরনের মন্তব্য করার জন্য দ্রুত আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।” এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু দাবি করেছেন, “সারদা-সহ সব চিট ফান্ড মালিক ও তাঁদের রাজনৈতিক নেতাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।” পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ডের দাবি, “সারদার মোটা মাইনের উচ্চ পদস্থ কর্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হোক।”
সারা দিনের এই চাপান-উতোর দেখে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর সখেদ মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গে গত ৪০ বছরে এমন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট আসেনি!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.