চল্লিশ বছরের পুরনো দলটা ভেঙে গিয়েছিল বছর খানেক আগে। সেই ক্ষত জোড়া দিয়ে আবার সকলে আসরে নেমেছিলেন। পালা আসতে শুরু করেছিল। মুখোশ আর রঙচঙ মেখে ফের ছৌয়ের আসর মাত করতে শুরু করেছিলেন ওঁরা কয়েক জন। গরিবগুর্বো মানুষগুলো ফের টাকার মুখ দেখছিলেন একটু একটু করে। রবিবার ভোরের দুর্ঘটনা কয়েক মুহূর্তে ফের ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল দলটাকে। কেড়ে নিল সাত শিল্পীর প্রাণ।
খবর পৌঁছতেই বরাবাজারের লটপদা গ্রামের কেউ ঘরে বসে থাকতে পারেননি। গোটা গ্রাম নেমে আসে রাস্তায়। কোথা থেকে এতটুকু খবর আসবে পরিজনদের, সেই আশায় হাপিত্যেশে বসে সকলে। বেলার দিকে একে একে মৃত্যুর খবর পৌঁছল। বড় মর্মান্তিক সে খবর। গাঁয়ের ঘরে ঘরে কান্নার রোল। এ দিন হাঁড়ি চড়েনি গেরস্থ বাড়িতে। |
চল্লিশ বছরের পুরনো দলটা ভেঙে যাওয়ার পরে ফের গড়েপিটে নিতে উদ্যোগী হন গাঁয়ের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ইসলাম আনসারি, লালন পুরস্কারপ্রাপ্ত ঝুমুর গায়ক শলাবত মাহাতো, ছৌ দলের প্রবীণ ওস্তাদ জটল কর্মকারেরা। ফের শুরু হয় মহড়া। শলাবত মাহাতোর ভাইপো কান্টু বলেন, “খবরটা শোনার পরেই জ্যাঠা ঘর থেকে কোথায় বেরিয়ে গেলেন। মনে হয় বড় শোক পেয়েছেন।’’ দলের আর এক সদস্য জটলবাবুর আক্ষেপ, “পশ্চিম মেদিনীপুরে একটা অনুষ্ঠান থেকে শনিবার ফিরতে দেরি হওয়ায় ওদের সঙ্গে যেতে পারিনি। আমি থাকলে হয় তো এত জোরে গাড়ি চালাতেই দিতাম না।” দুর্ঘটনায় মৃত শিল্পী কল্যাণের দাদু অতুল পরামানিক বলেন, “ছৌ দল হিসেবে আমাদের গ্রামের সুনাম আছে। দলে যোগ দেওয়ার জন্য নাতিটা বায়না ধরায় ওকে বাধা দিইনি। কিন্তু এমনটা ঘটবে কে জানত!” যাত্রাপাড়ায় খড়ের ছাউনির আটচালার বাঁশের খুঁটিটা ধরে কাঁপছিলেন বছর তিরিশের লক্ষ্মীকান্ত পরামানিক। ওই আটচালাতেই বসত ছৌয়ের মহড়া। ‘লটপদা শালপলাশ ছৌ নৃত্য পার্টি’র সখীর ভূমিকা তাঁর। দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িতে ছিলেন নিজেও। নৃত্যশিল্পী লক্ষ্মীকান্তের কথায়, “জীবনে এত বড় কঠিন পরিস্থিতির সামনে কখনও পড়িনি।”
ইসলাম আনসারি নিজেও দুর্ঘটনায় চোট পেয়েছেন। তাঁর বাবা শেখ হিম্মত আলি আনসারির বয়স হয়েছে। তাঁর চিন্তা শুধু ছেলেকে নিয়ে নয়। লুঙ্গির খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “আমার তো সাত সাতটা ছেলে হারিয়ে গেল। এই ক্ষতি কি আর পূরণ হবে? দলটা কি আর দাঁড় করানো যাবে?”
দুর্ঘটনায় সাত সন্তানকে তাই হারিয়ে সবটুকু হিম্মত খুইয়ে ফেলেছেন বৃদ্ধ হিম্মত।
|