করিম বেঞ্চারিফা কখনও যা করেন না, তাই করলেন ম্যাচের পর!
মোহন কোচ ড্রেসিংরুমের দরজা বন্ধ করে বোর্ডের দিকে আঙুল তুলে ওডাফা-টোলগেদের বোঝাচ্ছিলেন, কী কী ভুলে ভরাডুবি হল। ভুলটা ঠিক কোথায়!
সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে সেই বন্ধ ঘরের পাশ দিয়েই হাঁটছিলেন সুভাষ ভৌমিক। স্বগোতোক্তির মতো তখনই তাঁর মুখে শোনা গেল “বাপি বাড়ি যা!”
আরোপিত গাম্ভীর্য আর পেশাদারিত্বে মুড়ে রাখা চার্চিল টিডি-র মনোভাবটা যে তিনটি শব্দে মুহূর্তে প্রকাশ হয়ে পড়ল, চৌম্বকে রবিবারের ম্যাচ তার সঙ্গে সব অর্থেই মানানসই।
করিমকে কোনও কালেই পছন্দ করেন না নিউ আলিপুরের বাসিন্দা। যা সর্বজনবিদিত। তাঁকে রিংয়ের বাইরে পাঠানোর জন্য সব অস্ত্র প্রয়োগ করবেন সেটাও জানা ছিল। কিন্তু শুধু মরক্কান কোচকেই শুধু নয়, পি কে-র ‘ভোম্বলবাবু’ এ দিন ‘বাড়ি’ পাঠিয়ে দিলেন একসঙ্গে অনেককেই।
‘বাড়ি’ পাঠানোর তালিকায় প্রথম নাম যদি হয়, ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের ইস্টবেঙ্গল তা হলে, দ্বিতীয় নামটি অবশ্যই ডেরেক পেরিরার পুণে এফসি। খেতাব যুদ্ধে পিছন থেকে তাড়া করতে থাকা দু’দলের সব উদ্যম শুষে নিল চার্চিলের গ্যাবনিজ স্ট্রাইকার হেনরির দু’টো গোল। বাকি দু’ম্যাচের (এয়ার ইন্ডিয়া আর ফিরতি মোহনবাগান) একটি ড্র করলেই আই লিগের ইতিহাসে নাম তুলে ফেলবেন সুভাষ। যা শুধু সময়ের অপেক্ষা। গোয়া বা পুণে যেখানেই সেটা ঘটুক, দেশের একমাত্র কোচ হিসাবে দু’টো আলাদা ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করার অনন্য রেকর্ড সে দিন গড়ে ফেলবেন চার্চিলের বাঙালি কোচ। বাংলার একমাত্র কোচ হিসাবে অন্য রাজ্যে গিয়ে কোনও ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করার নজিরও এসে যাবে তাঁর মুঠোয়। নির্লিপ্ত সুভাষ যা শুনে অবশ্য ‘নেতাজি’ হয়েছেন। বলে দিয়েছেন, “আমি তো শুধু বাংলার নই, সারা ভারতের।” |
হাসি-কান্না |
জেতার পরে সুভাষ ভৌমিকের উচ্ছ্বাস। |
বিষণ্ণ ওডাফা। রবিবার। |
|
এ তো প্রকাশ্যে ‘বাপি বাড়ি যা’-র উদাহরণ! কিন্তু কল্যাণী স্টেডিয়ামের মঞ্চের বাইরেও তো রয়েছে অসংখ্য ‘বাড়ি যা’-র গল্প। বাংলায় এসে ওডাফা-টোলগেদের হারিয়ে উপচে পড়া স্টেডিয়াম স্তব্ধ করে দিলেন সুভাষ। দেখালেন, কলকাতা তাঁকে বাতিল করলেও তিনি এখনও চ্যাম্পিয়ন-কোচ। চৌষট্টি বছর বয়সে, বুকে পেসমেকার নিয়েও কার্যত তারকাহীন একটা দলকে তুলতে পারেন এভারেস্টের চুড়োয়।
চার্চিলের এই কার্যত চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়াকে অনেকে বলছেন, বাংলার ক্লাব কর্তাদের বিরুদ্ধে রোষের বিস্ফোরণ!
বছর চল্লিশের বর্ধমানের যে ছেলে, এ দিন চার্চিল গোলের নিচে দাঁড়িয়ে অতিমানব হয়েছিলেন, সেই সন্দীপ নন্দীও তো বিতাড়িত বাংলা থেকে। মর্গ্যান চাইলেও গত বার তাঁকে দলে নেননি লাল-হলুদ কর্তারা। মোহনবাগানের অন্তত চারটি নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে ম্যাচের সেরা হওয়ার পর সন্দীপের মুখ থেকে বেরোল, “মর্গ্যান নয়, অন্য অনেককে দেখানোর প্রয়োজন ছিল। জেদটাই কাজে লাগিয়ে চলেছি।”
সুভাষের সঙ্গে সন্দীপের জেদ মিলেমিশে একাকার। দুই ‘স’ একসঙ্গে তিন বার জাতীয় লিগ খেতাবের সামনে। অন্য ‘স’সুনীল ছেত্রীর জেদও তো চার্চিল-সমুদ্রে মিশে গেল এ দিন। চার্চিলের দুটি গোলের পাসই তো সুনীলের। যিনি মোহনবাগান থেকে বিতাড়িত হয়ে দল না পেয়ে পর্তুগাল চলে গিয়েছিলেন গত বছর।
সুভাষ ভৌমিক বনাম করিম বেঞ্চারিফার ধুন্ধুমার লড়াইয়ে দাঁড়ি পরে গিয়েছিল অবশ্য ৩৪ মিনিটের মধ্যেই। সুনীল-হেনরি যুগলবন্দিতে। ধুরন্ধর চার্চিল কোচের নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি বোকা বানিয়ে দিল চতুর মোহন-কোচকে। ম্যাচ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ওডাফা-টোলগেদের খেলার প্রতিটি মুহূর্ত কী নিখুঁত ভাবেই না পর্যবেক্ষণ করেছেন সুভাষ। কী অসাধারণ গেম প্ল্যানিং! ম্যাচ রিডিং!
করিমের স্ট্র্যাটেজি গুড়িয়ে দিতে তিন চাল দিলেন সুভাষ। তাতেই বাজিমাত।
এক) গোলমেশিন ওডাফাকে অকেজো করতে বড় চেহারার বিদেশি তোম্বাকে ব্যবহার করলেন। সুভাষ জানতেন, ওডাফাকে বল ধরতে না দিলেই টোলগে হামাগুড়ি দেবেন।
দুই) নবির দৌড় আটকাতে বিদেশি বেলাল আরজুকে কোনাকুনি ব্যবহার করা হল।
তিন) শুরুতে আক্রমণের ঢেউ তুলে গোল তুলে নাও তার পর নিজেদের গোলমুখ বন্ধ করে দাও।
সঙ্গে যোগ হয়েছিল পাস-পাস-পাসের বুনন। প্রথমার্ধে যা বেদম করে দিল বাগানকে। দ্বিতীয়ার্ধে স্নেহাশিস-জুয়েল-মণীশ ভার্গবকে নামিয়ে পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা করলেন করিম। কিন্তু ততক্ষণে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে সুভাষ ব্রাদার্সের। ব্যক্তিগত দক্ষতায় গোলের কয়েকটা সুযোগ তৈরি করেছিলেন ওডাফা। তাঁর একটি শট গোললাইন সেভ করেন ডেঞ্জিল।
ম্যাচের পর ওডাফা-নবি রিজার্ভ বেঞ্চে একে অন্যের দিকে তেড়ে গেলেন। হতাশায়, যন্ত্রণায়। কোচ-কর্তারা সামাল দিলেন। তবে সে দিকে তখন নজর ছিল না কারও।
সুভাষকে ঘিরে মাঠের মধ্যে যে, তখন শুরু হয়ে গিয়েছে সুনীল-হেনরিদের নাচ! আগাম উৎসব!
মোহনবাগান: শিল্টন, নবি, নির্মল, আইবর, বিশ্বজিৎ (মণীশ ভার্গব), ডেনসন, মণীশ মৈথানি (জুয়েল), কুইনটন, সাবিথ, টোলগে, ওডাফা।
|