দল বড়, না দেশ বড়, এই দ্বন্দ্বের নিরসন করিতে গিয়া এ দেশে রাজনীতিকরা সচরাচর দলকেই অগ্রাধিকার দিয়া থাকেন। দেশ বা জাতির বৃহত্তর স্বার্থ অপেক্ষা দলের কিংবা প্রাদেশিক দলীয় শাখার সংকীর্ণ স্বার্থই প্রাধান্য পাইয়া যায়। ছিটমহল বিনিময় লইয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সহিত চুক্তির ক্ষেত্রেও সেই সংকীর্ণ প্রাদেশিকতারই জয় দেখা যাইতেছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ও তাহার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান যে চুক্তির অনুকূল নহে, তাহা জানা ছিল। সম্প্রতি বিজেপির পশ্চিমবঙ্গীয় শাখার আপত্তি ও প্রতিবাদ সেই প্রতিকূলতাকে আরও শক্তি দিয়াছে। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের আপত্তি শিরোধার্য করিয়া ঘোষিত অবস্থান সংশোধনে বাধ্য হইয়াছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী ও সুষমা স্বরাজ সহ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তিস্তার জলের প্রাপ্য ভাগ লইয়া জিদ ধরিয়া থাকেন, তখন তাঁহার এই অবস্থানের পিছনে রাজ্যের স্বার্থ তথা উত্তরবঙ্গের কৃষিজীবী মানুষদের স্বার্থ রক্ষার একটি সঙ্গত তাগিদ থাকে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যে তাগিদ তিনি এড়াইতে পারেন না। কিন্তু বিজেপির বরাবরের ঘোষিত অবস্থানই ছিল, বাংলাদেশের সহিত মৈত্রীর বৃহত্তর স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক অগ্রাধিকারকে উপেক্ষা করা। কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রীর সহিত দফায় দফায় আলোচনায় আডবাণী ও সুষমা এই মর্মে সরকারকে আশ্বাসও দেন। বিশেষত ছিটমহল হস্তান্তর দেশের স্থলসীমান্ত পুনর্বিন্যাস করার ব্যাপার, সে জন্য সংসদে সংবিধান সংশোধনী আনিতে হয়, যাহা অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন দাবি করে। সরকার সেই সংশোধনী আনিলে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তাহাকে সমর্থন করিবে, এমন আশ্বাসও দেওয়া হয়। অথচ আজ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির আপত্তিতে দলের সেই অবস্থান পাল্টাইয়া ফেলার আয়োজন চলিয়াছে।
রাজ্য বিজেপির যুক্তিও বিচিত্র: ছিটমহল বিনিময় হইলে ভারতের ভাগ্যে জুটিবে ৭ হাজার একর জমি, আর বাংলাদেশকে ছাড়িয়া দিতে হইবে ১৭ হাজার একর এতখানি ত্যাগ স্বীকার অলাভজনক। অথচ ছিটমহল বিনিময়ের প্রশ্নটি বিনিময়যোগ্য জমির আয়তনের সহিত কোনও কালেই যুক্ত ছিল না, এখনও নাই। ইহা এক দেশের নাগরিকের অন্য দেশের ভৌগোলিক সীমানায় আটকাইয়া পড়ার অসুবিধা মীমাংসার লক্ষ্যে গৃহীত একটি পরস্পর-গ্রহণযোগ্য বন্দোবস্ত। এই হস্তান্তর বা বিনিময় কোনও বাণিজ্যিক লেনদেন বা পণ্য কেনাবেচার বিষয় নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কূটনীতির সাফল্যের স্বার্থেই ছিটমহলের মতো সমস্যাগুলিকে মিটাইয়া লওয়া উচিত। সে জন্য দুই-চারি কাঠা জমি ছাড়িতে হইল কি না, সেই প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর। সাত বনাম সতেরো একরের অঙ্ক কষিয়া বিজেপি আপন বিদেশ নীতি তথা প্রতিবেশীদের সম্পর্কে তাহার ভাবনা নির্ধারণ করিবে কি না, তাহা দলনেতাদের ভাবিয়া দেখা কর্তব্য। বিশেষত, যে দল আপনাকে দেশ শাসনের ‘স্বাভাবিক দাবিদার’ মনে করে। |