যাত্রীরা নোংরা করলে ৫০০ টাকা জরিমানার আইন করেছে রেল। কিন্তু এ বার রেল স্টেশনে দৃশ্য দূষণের কারণ হয়ে উঠেছেন রেলকর্মীদের একাংশ। তাঁদের হাত থেকে রেহাই মেলেনি শহরের গর্ব মেট্রো রেলেরও। এবং এই দৃশ্য দূষণের কারণরেলের কর্মী ইউনিয়নের নির্বাচন।
রেল সূত্রের খবর, আগামী ২৫, ২৬, ২৭ এপ্রিল দেশ জুড়ে রেলের সব ক’টি জোনে কর্মী ইউনিয়ন নির্বাচন। তার জেরেই সাজো সাজো রব রেলের শ্রমিক সংগঠনগুলিতে। বিভিন্ন স্টেশনে সংগঠনগুলির পোস্টার, ব্যানার দেখে চট করে লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন বলে বিভ্রম হওয়াটাও অসম্ভব নয়। এক কর্তা জানিয়েছেন, মাঝে প্রচার এতটাই ‘জোরদার’ হয়ে উঠেছিল, যে পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও মেট্রো রেলের সদর দফতরের দেওয়ালগুলি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল পোস্টার ব্যানারে। |
নিষেধ সত্ত্বেও এ ভাবে দেওয়াল জুড়ে সাঁটা হয়েছে পোস্টার। রবিবার, দমদম স্টেশনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
শেষ পর্যন্ত দেওয়াল সাফ করতে খোদ জেনারেল ম্যানেজারকে নির্দেশ দিতে হয়।
ওই কর্তার কথায়, “পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দফতর হেরিটেজ ভবন বলে চিহ্নিত। জেনারেল ম্যানেজারেরা হস্তক্ষেপ না করলে সেগুলির দফারফা হয়ে যেত।” সদর দফতরের দূষণ দেখে না হয় রেলের শীর্ষ কর্তাদের টনক নড়েছে। কিন্তু আমজনতার স্টেশন দেখবে কে, সে প্রশ্ন অবশ্য ইতিমধ্যেই রেলের অন্দরে উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনের রায়ে অনুমতি ছাড়া নির্বাচনী দেওয়াল লিখন এখন নিষিদ্ধ। এই নির্বাচন তার আওতায় না হলেও নীতির প্রশ্নে এমন ঘটনা কী করে ঘটছে, তাই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কেন এ বার এত তোড়জোড়?
রেল সূত্রের খবর, গত বছর রেল কর্মী ইউনিয়ন নির্বাচনে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলে বামপন্থী মেন্স ইউনিয়ন ও কংগ্রেসপন্থী মেন্স কংগ্রেস, একসঙ্গে জিতেছিল। মেট্রো রেলে অবশ্য নির্বাচন হয়নি। এ বছর মেট্রোয় নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তৃণমূলও। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলে চারটি সংগঠন এবং মেট্রোয় পাঁচটি সংগঠন লড়ছে। ভোট দেবেন প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার কর্মী। এক রেলকর্তার কথায়, “রাজ্য-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনটি বড় দলের সমর্থিত সংগঠনগুলি রেলের মতো ব্যাপক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা দখল করার দৌড়ে থাকার জন্যই এত হাঁকডাক শুরু হয়েছে।” আর তাতেই বেহাল দশা হয়েছে রেল পরিবেশের। মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর সৌন্দর্যায়নও।
রেল কর্তারা জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যের দু’টি জোনে (পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব) একগুচ্ছ স্টেশনকে হেরিটেজ ও আদর্শ স্টেশন বলে ঘোষণা করেছিলেন। সেই মতো কাজও হয়েছে। তার অধিকাংশই এখন তুলনায় দৃশ্যনন্দন হয়েছে। রেল সূত্রের খবর, এই নির্বাচনের জেরে তার অনেকগুলিই ফের আগের বেহাল দশায় ফিরে গিয়েছে। ঘটনাচক্রে, সেগুলির পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূলের অনুমোদিত ইউনিয়নের অবদানও কম নয়। পিছিয়ে নেই বর্তমান রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর দল কংগ্রেসও।
যদিও রেল কর্মীদের এই আচরণ মেনে নিতে চাননি রেল প্রতিমন্ত্রী। অধীরবাবু বলেন, “এরা সার্বিক সমস্যা নয়, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি। তা ছুঁয়েছে আমাদের কর্মীদেরও। আমি আর কী করব!” তবে পরিবেশ সম্পর্কে রেলের সব কর্মীরই সচেতন থাকা উচিত বলে তিনি জানান।
তবে এই দূষণে মূল যাঁরা দায়ী, সেই রেল সংগঠনের নেতারা কী বলছেন? বাম মনোভাবাপন্ন ইস্টার্ন রেলওয়ে মেন্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষকুমার ব্রহ্ম অবশ্য রেল স্টেশন ও দফতরে নোংরা করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকার কথা মেনে নিয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্য, “অন্য সংগঠনগুলি করছে, তাই আমরাও পোস্টার সাঁটাচ্ছি।” তবে তৃণমূলপন্থী ইস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ওয়ার্কার্স কংগ্রেসের নেতা তমোনাশ ঘোষ বলছেন, “রেল কোনও আপত্তি করেনি বলেই পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। তবে আমি নীতিগত ভাবে এর বিরোধী।” তবে পোস্টার খোলার ব্যাপারে রেলের আপত্তির দিকেই চেয়ে রয়েছেন তিনি।
বাম ও তৃণমূলপন্থীরা এ সব বললেও কংগ্রেসপন্থী সংগঠন ইস্টার্ন রেলওয়ে মেন্স কংগ্রেস অবশ্য রেল প্রতিমন্ত্রীর সুরেই গলা মিলিয়েছে । তাদের সহ-সভাপতি পরেশ সরকার বলেন, “নির্দিষ্ট জায়গায় পোস্টার মারা উচিত ছিল। আমরা এগুলি শীঘ্রই তুলে নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছি।” কিন্তু খারাপ কাজ জেনেও তাদের কর্মীরা পোস্টার সাঁটিয়েছিলেন কেন, সে জবাব অবশ্য পরেশবাবুর কাছে মেলেনি।
|