হঠাৎই উত্তাল বিনিয়োগের বাজার। উত্থান, পতন, আশা, আকাঙ্ক্ষা সব মিলিয়ে জমজমাট ছিল গত সপ্তাহটা। তারা খসার গতিতে আদরের সোনার দাম আকাশ থেকে মাটির কাছাকাছি নেমে আসায় আর ‘আঙুর ফল টক’ বলছেন না অনেকেই। এই পতনে অবশ্য বিপাকে পড়েছেন লগ্নিকারীরা। বলা নেই, কওয়া নেই এক ঝটকায় এতটা পতন? সোনার ইতিহাসে নেই।
শেয়ার বাজারের ব্যবহারটা হয়েছে ঠিক উল্টো। দুর্বল বাজার একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছিল। সেনসেক্স নেমে এসেছিল ১৮ হাজারের কাছাকাছি। প্রমাদ গুনছিলেন অসংখ্য লগ্নিকারী। এমন অবস্থায় হঠাৎই ‘ইউ টার্ন’। সপ্তাহ শেষে সেনসেক্স আবার ১৯ হাজারের ঘরে। সবাই ভাবছেন, এমনটা কেন হল। একটু দেখে নেওয়া যাক।
বিশেষজ্ঞদের অনেককেই বোকা বানিয়ে পরিস্থিতি হঠাৎই পাল্টেছে। আশার আলো দেখা দিয়েছে অর্থনীতিতে। মূল্যবৃদ্ধির হার গত ৪০ মাসের মধ্যে সবথেকে নিচু জায়গায় পৌঁছে যাওয়ায় ব্যাঙ্ক সুদের হার কমা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। গত অক্টোবরে মূল্যবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৩২%, সেখানে মার্চে নেমে তা দাঁড়িয়েছে ৫.৯৬%। ভাল রকম সুদ কমার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় উত্তেজিত শিল্প এবং শেয়ার বাজার। সুদ কতটা কমবে তা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ৩ মে পর্যন্ত। যে দিন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ঋণনীতির পর্যালোচনা করবে।
আশার আলো দেখাচ্ছে বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন পণ্যমূল্যের পতনও। ভাল রকম দাম কমেছে সোনা ও রুপোর। দাম কমেছে অপরিশোধিত তেল-সহ আরও কিছু পণ্যের। এর ফলে, আমদানি খরচ অনেকটাই কমবে। নেমে আসবে চলতি খাতে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। যা নিয়ে সরকার বিশেষ চিন্তিত। আমদানি কমার পাশাপাশি বাড়তে শুরু করেছে রফতানি, যা অর্থনীতির পক্ষে বড় আশার কারণ। মার্চ মাসে রফতানি বেড়েছে ৭%। আমদানি কমেছে ২.৮৭%। ফলে, বাণিজ্য ঘাটতি নেমে এসেছে ৯ মাসের মধ্যে সবথেকে নীচে। রফতানি বাড়ানোর লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সরকার ঘোষণা করেছে ৩০০০ কোটি টাকার এক নতুন প্যাকেজ। আমদানি করা পণ্যমূল্য খানিকটা করে নেমে আসায় আমদানির খরচ ফের কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি আরও কমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে জমি তৈরি হচ্ছে সুদ কমার। পরিস্থিতির গতি যদি একই রকম থাকে এবং রেপো রেট যদি ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানো হয়, তবে বাজারে আবার বুলদের দাপাদাপি দেখতে পাব, সন্দেহ নেই।
সোনা নিয়ে প্রশ্ন এখন সবার মনে। হঠাৎ কেন এমন হল? গত নভেম্বরের সর্বোচ্চ জায়গা (৩২,৪৬০ টাকা) থেকে সোনার দাম ২২% কমে সম্প্রতি নেমে আসে ২৫,৫৫০ টাকায়। কারণ হিসেবে যা পাওয়া যাচ্ছে তা হল: এক, মার্কিন অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরা এবং দুই, সাইপ্রাস সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সোনা বিক্রির ব্যাপারে আলাপ আলোচনা।
সোনা মানুষের দুঃসময়ের বন্ধু। বিশ্ব বাজারে মন্দা চলাকালীন অন্য অনেক জায়গা থেকে সরে এসে মানুষ ঢেলে সোনায় লগ্নি করেছিলেন। এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। মন্দা খানিকটা কেটেছে। মার্কিন অর্থনীতিতে আবার অগ্রগতির সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে। বহু লগ্নিকারী সোনা থেকে বেরিয়ে এসে শেয়ার এবং ডলারে লগ্নি করতে শুরু করেছেন। ফলে, বিক্রির চাপ এসেছে সোনার বাজারে। একই সঙ্গে সাইপ্রাসের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক চিন্তাভাবনা করছে সোনা বিক্রি করার। ফলে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সোনা বিক্রি করতে শুরু করেছেন লগ্নিকারীরা। এই কারণেই হঠাৎ পতন।
প্রশ্ন হল, এই জায়গা থেকে সোনার দাম কোন দিকে যেতে পারে। দাম এক ঝটকায় এতটা কমে আসায় বহু মানুষ আবার সোনা কিনতে শুরু করেছেন। ফলে, গত দু’দিনে বাড়তে দেখা গিয়েছে সোনার দাম। শনিবার দিল্লিতে সোনার দাম আবার স্পর্শ করেছে ২৭,০০০ টাকা (২৪ ক্যারাট, প্রতি ১০ গ্রাম) দাম বেড়েছে নিউ ইয়র্ক সোনার বাজারেও। অর্থাৎ পতন সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়েছে বলা চলে। দাম কমলে চাহিদা বাড়বে এই নিয়ম অনুযায়ী পতন হলেই দর একটি জায়গায় পৌঁছে ঠিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। মনে রাখতে হবে, সোনার জোগান অফুরন্ত নয়।
গত সপ্তাহে ফল প্রকাশ করছে বেশ কয়েকটি নামী কোম্পানি। যা আশা করা হয়েছিল, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি টি সি এস শেষ তিন মাসে ঘরে তুলেছে ৩৫৯৭ কোটি টাকার মুনাফা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২% বেশি। পুরো বছরে কোম্পানির নিট লাভ হয়েছে ১৩,৯৪১ কোটি টাকা। মোট আয় প্রায় ৬৩,০০০ কোটি টাকা। বর্তমানে সংস্থার কর্মী সংখ্যা ২.৭৬ লক্ষেরও বেশি।
এইচ সি এল টেকনোলজির ত্রৈমাসিক লাভ বেড়েছে প্রায় ৭৩%। ৩৩% লাভ বেড়েছে বেসরকারি ইয়েস ব্যাঙ্কের। ২০১২-’১৩ সালে এই ব্যাঙ্কের লাভ স্পর্শ করেছে ১৩০০ কোটি টাকা। আয় ও লাভের বাজারে যথারীতি সবাইকে টেক্কা দিয়েছে রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০১২-’১৩ সালে ৩.৭১ লক্ষ টাকার বিশাল আয়কে ভর করে মুকেশ অম্বানীর এই কোম্পানি ঘরে তুলেছে ২১,০০৩ কোটি টাকার নিট মুনাফা। শেষ তিন মাসে রিলায়্যান্সের লাভ ৩২% বেড়ে পৌঁছেছে ৫৫৮৯ কোটি টাকায়। এত ভাল ফলাফল সত্ত্বেও এই শেয়ারের দাম তেমন তেতে ওঠেনি।
এখন সকলের নজর থাকবে ৩ তারিখে সুব্বারাও কতটা সুদ কমান, সে দিকে। আশা, অনুযায়ী সুদ কমলে গাড়ি, ব্যাঙ্কিং এবং আবাসন-সহ অনেক ক্ষেত্রের শেয়ারই তেতে উঠবে আশা করা যায়। ভাল বর্ষারও পূর্বাভাস মিলেছে আবহাওয়া দফতর থেকে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অনুকূলে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ভাল লাগার পরিবেশ। |