সারদা গোষ্ঠীর অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকার তিন মহকুমা সদরেই। এজেন্টদের অনেকেই কলকাতায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। অনেকে তালাবন্ধ অফিসের সামনে দিয়ে মাঝে-মধ্যে ঘুরেও যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতেও বর্ধমান, কালনা ও কাটোয়া, তিন শহরেই রমরমিয়ে চলছে অন্য নানা ভুঁইফোড় সংস্থার অফিস।
সারদা-কাণ্ডের পরে এই তিন শহরে অন্য ভুঁইফোড় সংস্থাগুলির অফিস খোলা থাকলেও তাদের এজেন্টরা শঙ্কিত। বর্ধমানের ঢলদিঘির একটি আর্থিক সংস্থার এজেন্ট নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, “সংস্থার আধিকারিকেরা আমাদেরই পাল্টা চাপে ফেলছেন। বলা হচ্ছে, যদি আমরা নতুন ব্যবসা না আনি তবে যে সব পুরনো আমানতকারীদের আমানতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে না।” ওই এজেন্টের কথায়, “পেটের দায়ে আমানত সংগ্রহ করেছি। মানুষ তো আমার কথা শুনেই লগ্নি করেছেন। মেয়াদ উত্তীর্ণের পরে টাকা না পেলে তাঁরা তো যে ভাবে হোক আমার কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করবেন।” সব বুঝেও এখনও মানুষকে লগ্নি করতে উৎসাহ দিতে হচ্ছে তাঁদের, দাবি ওই এজেন্টের। |
বর্ধমানে নানা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে টাকা ঢালে শহরের একটি ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থা। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই সংস্থার কাছে বহু মানুষের টাকা ফেরত পাওয়ার কথা। কিন্তু সহজে তা পাচ্ছেন না তাঁরা। এমনকী গত মাস তিনেক ধরে ওই সংস্থার এজেন্টদের কমিশনও বকেয়া। গলসির বড়দিঘির বাসিন্দা মহম্মদ সালাউদ্দিন অভিযোগ করেন, গত ৯ এপ্রিল ওই সংস্থার অফিসে টাকা চাইতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সংস্থার কর্মীরা প্রথমে এক মাসের আগে টাকা ফেরতের ব্যাপারে কথা বলা যাবে না বলে জানিয়ে দেন। তিনি চেঁচোমেচি শুরু করলে সশস্ত্র লোকজন এসে তাঁকে বের করে দেয়।
এই সংস্থার চেয়ারম্যান সৌম্যরূপ ভৌমিকের বিরুদ্ধে হিসেব বহির্ভূত অর্থব্যয়ের অভিযোগ তুলে সংস্থার সভাপতি চন্দ্রশেখর সাবাত ২০১২ সালের ২৫ মে দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে পদত্যাগ করেন। আমানতকারীরা কেন টাকা পাচ্ছেন না, বা সশস্ত্র লোকজন আমানতকারীদের নিগ্রহ করছেন কেন, সৌম্যরূপবাবু সে সব নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি। সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান মদন অধিকারীও ফোন ধরেননি।
গত কয়েক বছরে বর্ধমান থেকে বেশ কয়েকটি ভুঁইফোড় সংস্থা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কর্তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। অনেকে আবার অন্য নামে সংস্থা খুলেছেন। কালনায় এক ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থার এজেন্টের কথায়, “আমি যে সংস্থার হয়ে আমানত সংগ্রহ করতাম, তা উঠে গিয়েছে। তার পরে এলাকার মানুষের জমা রাখা টাকা ফেরত দিতে ঘটিবাটি বেচতে হয়েছে আমাকে। তা-ও সবটা পারিনি।” পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া নানা সংস্থার অন্তত তিন জন এজেন্টের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের পরিবারের অভিযোগ, আমানতকারীদের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন তাঁরা।
তবে এ সব সত্ত্বেও বর্ধমান, কালনা বা কাটোয়ায় এই ধরনের সংস্থাগুলির রমরমা বন্ধ হয়নি। শনিবারও কাটোয়ায় ৪০টি ও কালনায় ২৯টি ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থার অফিস খোলা ছিল। কেতুগ্রামের কোজলসা গ্রামে আমানত তুলে সংস্থার কাছে জমা না দেওয়ার অভিযোগে বৃহস্পতিবার পুলিশ মোল্লা আলাউদ্দিন নামে এক এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে। কাটোয়ার কলেজপাড়ায় এক সংস্থার এজেন্টকে তাঁর বাড়িতে প্রায় দশ দিন ঘেরাও করে রেখেছিলেন আমানতকারীরা। পুলিশ উদ্ধার করার পরেই তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ জানায়, কেউ কোনও অভিযোগ না করায় ওই এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মানুষ টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হন, তবু পুলিশের কাছে তেমন অভিযোগ জমা পড়েনি কেন? কয়েক জন আমনতকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আর্থিক দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাবই এর প্রধান কারণ। কালনার ধাত্রীগ্রামের এক আমানতকারী, সব্জি বিক্রেতা রাকেশ সরকারের কথায়, “অনেক কষ্টে জমানো চার হাজার টাকা জমা রেখেছিলাম একটি সংস্থায়। তাদের বিরুদ্ধে কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে, তাই তো জানি না!”
বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “প্রতারিত হলে মানুষ স্বচ্ছন্দে থানায় নথিপত্র নিয়ে এসে ঘটনার কথা খুলে বলতে পারেন। পুলিশ তাঁদের সাহায্য করবে।”
|
(তথ্য সহায়তা: কেদারনাথ ভট্টাচার্য ও সৌমেন দত্ত) |