কাগজের দামও কি আর মিলবে, ধন্দে হকার |
কারও খেদ ভুল বোঝা নিয়ে। কেউ আবার আক্ষেপ করছেন বিশ্বাস করে। কষ্টের সঞ্চয় হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বহু আমানতকারী। নানা ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থায় আমানত রাখা মানুষজন জমানো টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে এখন চিন্তায় পড়েছেন। তাঁরা যোগাযোগ করছেন এজেন্টদের সঙ্গে। কিন্তু সেই সব এজেন্টরাও দিশাহারা।
দুর্গাপুরের সারদা গোষ্ঠীর অফিস বন্ধ হয়েছে শুক্রবার থেকে। আসানসোল, বার্নপুর ও সালানপুরে অফিসে ঝাঁপ পড়েছে বুধবার। তারও পনেরো দিন আগে থেকে আমানতকারীদের মধ্যে টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। অফিসে তালা পড়ার পরে এজেন্টদের পাকড়াও করে নিজেদের টাকা ফেরত চান তাঁরা। এজেন্টরা অবশ্য আশা দেখাতে পারেননি। |
টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয়ে সুশান্ত ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী। আসানসোলে।—নিজস্ব চিত্র। |
এমনই এক আমানতকারী আসানসোল ডিপোপাড়ার বাসিন্দা সুশান্ত ঘোষ। তিনি জানান, জমা রাখা প্রায় লক্ষাধিক টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন। টাকা ফেরত না পেলে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা চলবে কী করে, সে নিয়েই এখন চিন্তা, জানালেন সুশান্তবাবু। বার্নপুরের বৃদ্ধা অঙ্গুরবালা সরকার আবার বলছেন, “আর সুদের আশা করছি না। মূলধনটা পেয়ে গেলেই বেঁচে যাই।” একই বক্তব্য সালানপুরের সুফল মণ্ডল, গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারাবনির তারক মজুমদারদের।
শুধু সারদা নয়, শিল্পাঞ্চলের বহু মানুষ অন্য নানা সংস্থার কাছে টাকা রেখেছেন। আসানসোলের সেনর্যালে রোডের এমনই একটি সংস্থায় টাকা রেখেছেন রতিবাটির এক বাসিন্দা। তিনি আবার ওই সংস্থার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর দাবি, মার্চে তাঁর লক্ষাধিক টাকা আমানতের মেয়াদ ফুরিয়েছে। কিন্তু নিজের টাকা যেমন পাননি, অন্যদের টাকাও ফেরত দিতে পারছেন না। রূপনারায়ণপুরের ডাবর মোড়ের বাসিন্দা শুভেন্দু ভট্টার্চায জানান, তিনিও একটি সংস্থায় অনেক টাকা রেখেছেন। তাঁর কথায়, “রাতের ঘুম উড়েছে। আদৌ কিছু ফেরত পাব কি না, জানি না।” কুলটির ফাল্গুনী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, যে এজেন্টের মাধ্যমে লগ্নি করেছেন, তাঁর কাছে মূলধন ফেরত চেয়েছেন। ফাল্গুনীবাবু বলেন, “কিন্তু এজেন্ট জানিয়েছে, সংস্থার অবস্থা ভাল নয়। টাকা দিতে দেরি হবে।” সালানপুরের অভিজিৎ মণ্ডল জানান, গত ডিসেম্বরে একটি বেসরকারি লগ্নি সংস্থায় তাঁর ভাগ্নের কয়েক হাজার টাকার স্থায়ী আমানতের মেয়াদ ফুরিয়েছে। সেই টাকা পেতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। কুলটির দেবদাস নায়েকের দাবি, একটি বেসরকারি সংস্থায় তাঁর স্থায়ী আমানতের সুদ বাবদ গত তিন মাসে হাতে পাওয়া তিনটি চেক টাকা না থাকায় ব্যাঙ্ক ফেরত পাঠিয়েছে। তবে তাঁর এজেন্ট টাকা পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে, জানান তিনি।
আমানতকারীরা টাকা ফেরত চাইছেন, অথচ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সদুত্তর মিলছে না, এমনই অভিযোগ নানা অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট ও কর্মীদের। তাঁদের দাবি, এখন কী করা উচিত, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আসানসোল মহকুমাশাসকের দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে এমনই এক এজেন্ট বলেন, “আমি কয়েকটি লগ্নি সংস্থায় কাজ করি। মানুষ তো আমাদের বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছেন। তাই তাঁরা আমাদেরই ধরছেন। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।”
অফিস বন্ধ হয়ে গেলেও গত তিন দিন ধরে সারদা গোষ্ঠীর দুর্গাপুরের অফিসে ঘুরে যাচ্ছেন এজেন্ট ও গ্রাহকেরা। সেখানেও আমানতকারীদের একই বক্তব্য, এখন শুধু আসল ফেরত পেলেই বাঁচেন। শহরের সিটিসেন্টারে সংস্থার আর একটি ছোট অফিস ছিল। সেটি অবশ্য বহুদিনই তালাবন্ধ। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত সেখানে বোর্ড লাগানো ছিল। রবিবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, সেই অফিসের বোর্ড খুলে দেওয়া হয়েছে। লগ্নিকারিদের কী ভাবে আশ্বস্ত করা যায়, তা ঠিক করতে রবিবার দুর্গাপুরের রাজীব গাঁধী ময়দানে বৈঠক করেন সংস্থার বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়ার শ’দেড়েক এজেন্ট। বৈঠক শেষে দুর্গাপুরের অন্যতম প্রধান এজেন্ট বিপ্লব কুণ্ডু দাবি করেন, “রাজ্য সরকার আশ্বস্ত করেছে। তার ভিত্তিতেই আমরা এগোচ্ছি।” তিনি জানান, এজেন্ট ও গ্রাহকদের জন্য আলাদা দু’টি ওয়েলফেয়ার কমিটি গড়া হয়েছে। রাজ্যের ৩৫ জন এজেন্টকে নিয়ে কোর কমিটি হয়েছে। গ্রাহকদের নিয়েও তেমন কমিটি গড়া হচ্ছে। দু’টি কমিটির তরফেই আদালতে যাওয়া হবে বলে তাঁর দাবি।
দুর্গাপুরেও শঙ্কিত অন্য নানা অর্থলগ্নি সংস্থার আমানতকারীরা। সিটিসেন্টারে একটি সংস্থার অফিসে ভাঙচুর হয়েছে। আর এক সংস্থার এজেন্টরা মহকুমা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন। রবিবার সগড়ভাঙার দেশবন্ধুনগর এলাকায় এক সংস্থার এজেন্টের বাড়িতে ভিড় জমান কিছু লগ্নিকারী। এজেন্ট তাঁদের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। আমানতকারী সুখেন বসু, বিধান গড়াইদের অবশ্য দাবি, এজেন্টের আশ্বাসেও তাঁরা ভরসা পাচ্ছেন না।
রবিবার রাজ্যের মন্ত্রী তথা আসানসোলের বিধায়ক মলয় ঘটকের সঙ্গে দেখা করে কয়েক জন দাবি করেন, তাঁরা যে সংস্থায় টাকা জমা রেখেছিলেন, সেটি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। আমানতকারীদের পক্ষে ফরিদা বেগম জানান, শহরের রেলপাড় এলাকার অনেকের কাছে ওই সংস্থাটি বহু টাকা তুলেছে। ওয়েস্ট আপকার গার্ডেন অঞ্চলে সংস্থাটির একটি অফিস ছিল। বছরখানেক আগে সেটি বন্ধ করে সংস্থার লোকজন চম্পট দিয়েছে। মলয়বাবু তাঁদের পুলিশের কাছে গিয়ে লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেন।অফিস বন্ধ থাকলেও দুর্গাপুরে সারদা গোষ্ঠীর অফিসে শনিবার পর্যন্ত খবরের কাগজ দিয়েছেন হকার সত্যদেও ঠাকুর। তিনিও এখন ধন্দে, “কাগজের বকেয়া দামটা পাব তো?” |