কেউ কথা বলে না...
কেউ প্রতিবাদ করে না...
যাক কেউ তো বলছে

আপনার উপর সিনেমা হচ্ছে। অনুভূতিটা কেমন?
আরে, এটা তো কৌশিকের করার কথা ছিল। ও আমাকে ফর্ম-টর্ম’এ সইও করিয়ে নিয়ে গেল। অনেক দিন ছবিটা হল না। ‘শব্দ’-টা করার কথা ছিল এই ছবিটার পরে। সেটা আগে হয়ে গেল। কৌশিকের স্ক্রিপ্টটা তখন পড়েছিলাম। তার পর যখন ছবিটা হল না, তখন ভাবলাম কলকাতা তো আমাকে তাড়িয়েই দিয়েছে। আর বই ছাপা বন্ধ করে দিয়েছে প্রকাশকেরা। তখন ফিল্মটাও বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। তখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। যদিও এখানকার কিছু সাহিত্যিক-শিল্পীকে চিনি, তবু দিল্লিতে আমার কোনও সামাজিক জীবন নেই। মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, বিদেশে। কলকাতা থেকে বন্ধুবান্ধব এলে যা আড্ডাটাড্ডা হয়। বাকি সময় আমার লেখালিখি। আর সঙ্গী হিসেবে একমাত্র আমার বেড়াল মিনু।

ফিল্মটা নাকি মিনুকে ঘিরেই?
হ্যাঁ (হাসি)। মিনুকে দিয়ে ছবিতে অভিনয় করাবে কি না অবশ্য জানি না।

আপনার নামেই যেমন হুলস্থূল বিতর্ক। তাতে একটা গোটা ছবির কেন্দ্রীয় বিষয় আপনি। ফিল্মটা শেষ করা যাবে তো?
আমি জানি না কোনও বাধা আসবে কি না। তবে অসুবিধে হওয়া উচিত নয়। গল্পটা তো মুখ্যত আমার বেড়ালকে নিয়ে। এখানে তো মৌলবাদীদের কথা কোথাও বলা-টলা হয়নি। থিমটা খুব মজার— আমাকে কলকাতা থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে। আমি ইউরোপে। এ বার আমার বেড়ালটাকে কী করে আমার কাছে পাঠাবে তা নিয়ে তুলকালাম। পোস্টে বেড়াল যাবে? নাকি ক্যুরিয়ার করা হবে?

ছবির পরিচালকও তো বদলে গিয়েছে? এখন চূর্ণী করছেন।
চূর্ণী আগে কখনও পরিচালনা করেনি। কৌশিক সে দিক থেকে অনেক অভিজ্ঞ। তবে চূর্ণীর নিশ্চয়ই এত দিন কৌশিকের সঙ্গে থেকে থেকে পরিচালকের বোধ তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্লাস চূর্ণীর নিজেরও একটা স্বাভাবিক রুচিবোধ আছে। ওর অভিনয় যথেষ্ট উচ্চাঙ্গের। চূর্ণীর উপর বিশ্বাস আছে আমার যে ও পারবে। তা ছাড়া একজন মহিলা যখন ছবি করছে, সে হয়তো মহিলার সমস্যাও ভাল বুঝতে পারবে।

কী বলছেন? তসলিমার জীবনে তো পুরুষই আসল। পুরুষই কি তাঁর সমস্যা বেটার বুঝবে না?
এটা তো ঠিক আমার জীবন নিয়ে নয়। কৌশিকের স্ক্রিপ্টটা যদি চূর্ণী পুরো ফলো করে, তা হলে এটা আমার বেড়ালের জীবন। আমাকে তাড়ানোর পর বেড়ালটা কী করবে সেই আইডিয়ার উপর। কমেডি বলা যেতে পারে। লোকে খুব হাসবে।

আবার তার পিছনে বেদনাও আছে?
হ্যাঁ। বেদনাও আছে। স্যাটায়ার বলা ভাল।
ছবি সৌজন্য: তসলিমা নাসরিন
আপনার জীবনে প্রচুর সিনেমার উপাদান। কিন্তু বিতর্ক হবে ভেবে বোধহয় লোকে পিছিয়ে আসে।
তাই তো হয়। মহেশ ভট্ট বলেছিলেন আমার জীবনের উপর ছবি করবেন। তার পর কিছু দিন বাদে পুরো কথা উল্টে বললেন এ রকম কথা নাকি বলেননি। অদ্ভুত জীবন আমার! নিজের দেশ থেকে বহিষ্কৃত। যে বাংলায় ভালবেসে থাকতে এলাম, সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিল। আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোনও লেখককে এ রকম ভাবে দু’টো জায়গা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলুন তো? কোনও লেখকের এতগুলো বই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে? কতগুলো সরকার একই সঙ্গে একজন লেখককে এত আপত্তিকর মনে করেছে? আর সব কিছু দেখেশুনে সবাই মুখ বুজে আছে?

সবাই বলতে?
সবাই বলতে আমি রাজনীতিবিদ বা ধর্মান্ধদের কথা বলছি না। রাজনীতিবিদদের চরিত্র সবার জানা। আমি বলছি সাহিত্যিক, শিল্পী বা কবি যদি মুখ বুজে থাকেন, তা হলে ওঁদের নিজেদের জীবনের জন্য হয়তো ভাল হয়। সমাজের জন্য ভাল হয় না। এঁরা চুপ থাকলে সমাজ নষ্ট হয়ে যায়। যদি কেউ প্রতিবাদই করত, তা হলে কি কলকাতা বা বাংলাদেশ থেকে আমায় তাড়ানো যেত? নাকি আমার বই নিষিদ্ধ করা যেত?

সেই বাজারে দাঁড়িয়ে কেউ যে ছবি বানাচ্ছে, আপনার কেমন লাগছে?
মনে হচ্ছে কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেউ কথা বলেনি। যাক! কেউ তো বলছে। কেউ যেখানে কথা বলে না, সেখানে কেউ যদি বলতে যায় তাকে আমি স্বাগতই জানাব।

আপনার কথা অনুযায়ী তসলিমা নাসরিনের জীবন নিয়ে এটা নয়।
নয়তো। আমার জীবন নিয়ে করতে হলে তাকে ‘মেয়েবেলা’ করতে হবে। সেটা অনেক সিরিয়াস ছবি। আমার জীবন কেবল বেড়ালের গল্প নিয়ে হতে পারে না। তবে সমস্যা কী জানেন? আমার জীবন নিয়ে করলে হয়তো ডিস্ট্রিবিউটর বিতর্কের ভয়ে রাজি হবে না। হয়তো সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে বেড়াল নিয়ে গল্প করলে হয়তো ছবিটা শেষ করা সম্ভব হবে।
আর একটা কথা বলি, আগেকার প্যাটার্ন ছিল লোকে হাজার হাজার পাতার বই লিখে প্রতিবাদ করত। তীব্র আক্রমণ করত। সেটাই ছিল লেখকদের প্রতিবাদের ধরন। এখন ছোট বিদ্রুপ করাটা অনেক সময় বেশি এফেক্টিভ।

জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনার কি তা হলে মনে হচ্ছে আক্রমণের চেয়ে বিদ্রুপ বেশি কাজের?
যুগ আসলে পাল্টে গিয়েছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটস পৃথিবী বদলে দিয়েছে। বড় প্রবন্ধের চেয়ে ফেসবুকে একটা কার্টুন পোস্ট করে দেওয়া এখন অনেক বেশি এফেক্টিভ। বিদ্রুপটা মনে রাখবেন এক ধরনের আক্রমণ-ই। সে ফিল্মে হোক কী ট্যুইটার ফেসবুকে। এই তো ইন্দোনেশিয়ায় একজন ট্যুইট করেছিল ‘গড ডাজ নট এক্সিস্ট’। সে এখন জেলে। পরশুদিন তুরস্কে এক জন বিখ্যাত পিয়ানো বাদক আজান নিয়ে কিছু কথা ট্যুইট করেছিলেন। ওই একটা লাইনের জন্য তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে তো একটা ট্যুইটের জন্য অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়ে যায়। মৌলবাদীদের আমার ট্যুইট ভাল লাগেনি। তাঁরা কেউ মামলা করেছিলেন পটনা হাইকোর্টে। ফলে গত ছ’মাস আমি ভারত ছেড়ে বেরোতে পারিনি। বেরোলেই আমাকে অ্যারেস্ট করা হত। এই সে দিন পটনা হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ বের করতে পেরেছি। নইলে তুচ্ছ একটা ট্যুইটের জন্য ছ’মাস শহর-বন্দি থাকলাম।

তার মানে কি মনে হচ্ছে বিদ্রুপ করে বেড়ালের উপর ছবি থেকেও অনেক কিছু বলা যেতে পারে?
পুরোটা না হলেও কিছুটা তো বলা যেতেই পারে। আর আপনাকে তো বললামই, আজকের দিনে এক লাইনের বিদ্রুপও ভীষণ এফেক্টিভ । হতে পারে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.