|
|
|
|
তসলিমা চূর্ণী একটা বেড়াল |
নিঃসঙ্গ এক নারী। সঙ্গে শুধু মিনু - তাঁর বেড়াল।
তসলিমা নাসরিন-এর
জীবন নিয়ে ছবি।
পরিচালনায় প্রথম চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়। লিখছেন ইন্দ্রনীল রায় |
তসলিমা আর একা নন।
তাঁর পোষা বেড়াল মিনু তো তাঁর পাশে ছিলই।
এ বার তাঁরা দু’জনেই পেয়ে যাচ্ছেন আর এক জন মানুষকে। না, কোনও পুরুষ নন। ইনি নারী।
চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়।
এ বার তিনি পরিচালনায়।
ছবির নাম ‘নির্বাসিত’। ইংরাজি টাইটেল ‘ব্যানিশড্’। শ্যুটিং শুরু অগস্ট মাস থেকে।
ছবিটি প্রযোজনা করছেন ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
তসলিমা নাসরিন ও তাঁর বেড়ালের একাকিত্বের জীবন নিয়ে গত এক বছর ধরে ‘নির্বাসিত’র স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছেন চূর্ণী। মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করবেন তিনি।
প্রসঙ্গত, এই ছবিটা করার কথা ছিল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের। কিন্তু অন্যান্য কয়েকটি ছবির কাজ এসে যাওয়ায় তাঁর এই ছবিটা বানানো হয়নি।
কিন্তু একই সঙ্গে অভিনয় ও পরিচালনা? অপর্ণা সেনও প্রথম ছবিতে নিজে নায়িকা চরিত্র করার সাহস দেখাননি। কী ভাবে দু’টোকে ব্যালেন্স করবেন চূর্ণী?
“দেখুন ছবিটা এত পরিষ্কার আমার মাথায়, আমার মনে হয় না কোনও অসুবিধা হবে। যে ভাবে শু্যট করা হবে, লোকেশন, চরিত্রদের লুক, পুরো ডিটেলটাই স্ক্রিপ্টে রয়েছে। আর যে সিনগুলোতে আমি অভিনয় করব সেখানে সিনেমাটোগ্রাফারের সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা ঠিক থাকলে কোনও অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়,” সাফ জানাচ্ছেন তিনি।
কিন্তু প্রথম ছবিতে শুধু ডিরেকশনে মনোযোগ দিলে কি সুবিধা হত না?
“আমি অভিনয় করব বলে তো স্ক্রিপ্টটা লিখিনি। কৌশিকের এই স্ক্রিপ্টটা আনফিনিশড্ ছিল। সেটাকে ডেভেলপ করতে করতেই আমার মনে হয়েছিল আমি এই ছবিটা ডিরেক্ট করতে পারব। আমি খুব সম্মানিত, শ্রীকান্তের মতো এক জন আমাকে এই ছবিটা ডিরেক্ট ও অভিনয় করতে বলেছেন বলে। ইটস আ বিগ অনার,” কাস্টিংয়ের কাজ ফাইনাল করার মাঝে বলছিলেন চূর্ণী।
কিন্তু হঠাৎ পরিচালনায় আসার কারণ?
“হঠাৎ নয়। আমি কৌশিকের বিভিন্ন স্ক্রিপ্ট ইনপুটস দিই। এটাতেও তাই করতে করতে আমি এতটাই ইনভলভড্ হয়ে যাই যে স্ক্রিপ্টটা অনেকটা নিজের মতো করে লিখে ফেলি। আর পরিচালনা যে করতে পারব এটা আমার ইনস্টিংটিভ ডিসিশন,” জানাচ্ছেন তিনি।
জানা গেল, গত এক বছরে তসলিমা নাসরিনের প্রায় সব লেখাই তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছে। “এক বার নয়, একাধিকবার পড়েছি তসলিমাদির লেখাগুলো। ওঁকে চিনতে গেলে লেখাগুলো যে একাধিকবার পড়া দরকার সেটা বার বার মনে হয়েছে আমার।”
তা তসলিমা কি স্ক্রিপ্টটা শুনেছেন?
“হ্যাঁ, প্রথম খসড়া লিখেই তো ওঁকে পাঠানো হয়েছিল। উনিও অ্যাপ্রুভ করেছেন স্ক্রিপ্টটা। মেল-এ আমার সঙ্গে যোগাযোগও রয়েছে ওঁর। গত শুক্রবার উনি আমাকে সুন্দর একটা মেলও করেছেন। খুব খুশি হয়েছেন এটা জেনে যে আমি পরিচালনা করছি। তাড়াতাড়ি দিল্লি গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতেও বলেছেন। এমনকী এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে পিক-আপ করবেন এটাও জানিয়েছেন,” বলছেন তসলিমাকে যিনি পর্দায় ফুটিয়ে ওঠাবেন তিনি।
কথা বলতে বলতে জানা গেল, তসলিমা যখন কলকাতা ছেড়ে চলে যান, তখন তাঁর বেড়াল মিনুকে তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। ‘নির্বাসিত’র গল্পটাও এই দু’জনের একাকিত্বের গল্প।
আপাতত এটাও ঠিক হয়েছে, ২ মে, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ‘শব্দ’র জন্য ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড নিতে দিল্লি যাচ্ছেন কৌশিক ও চূর্ণী।
সেই সময় তসলিমার বাড়িতে তিন দিন থাকবেনও চূর্ণী।
কিন্তু হঠাৎ তসলিমার বেড়াল নিয়ে ছবি করছেন কেন তিনি? লোকে তসলিমার বেড়াল নিয়ে কেনই বা উৎসাহিত হবে?
“এটা ইন্সিডেন্টাল যে আমার প্রথম ছবি তসলিমার বেড়াল নিয়ে। অন্য কোনও গল্প হলেও যদি সেটা আমাকে পরিচালক হিসেবে উদ্বুদ্ধ করত, আমি সেই ছবিই বানাতাম। আর মানুষ উৎসাহিত হবে তার কারণ তসলিমার বেড়াল মিনু আমার কাছে নিঃসঙ্গতার প্রতীক। আমার কাছে বেড়ালটা একটা মেটাফর। তাই জন্যই মিনুর প্রসঙ্গটা এসে পড়েছে গল্পতে খুব সহজাত ভঙ্গিতেই। আর তসলিমা যখন কলকাতা ছেড়ে চলে যান, তখনই নানা আলোচনায় জানতে পারি, তসলিমা ওঁর সঙ্গে বেড়ালটাকে নিয়ে যেতে পারেননি। বেচারি প্রাণীটার তো কোনও দোষ নেই। আমার কাছে সেটা ভীষণ সেনসিটিভ লেগেছে,” জানাচ্ছেন ‘শব্দ’ ছবির ডা. স্বাতী।
যাঁর আইডিয়া থেকে এই স্ক্রিপ্টটা ফাইনালাইজ করে চূর্ণী পরিচালনাতে আসছেন, সেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কী বলছেন? “গল্পটা মাথার মধ্যে থাকলেও আমি সময় পাচ্ছিলাম না স্ক্রিপ্টটা ফাইনালাইজ করার। এর মাঝে তসলিমার কিছু কবিতা আর বাংলা স্ক্রিপ্ট ইংরাজিতে ট্রানস্লেট করতে অনুরোধ করি চূর্ণীকে। ইংরাজি ট্রানস্লেশন করার ফাঁকে ফাঁকে ও স্ক্রিপ্ট-এ কিছু চেঞ্জ করে একদিন আমাকে বলে, ‘আমি এটা ডিরেক্ট করতে চাই’। ট্রানস্লেশন ও স্ক্রিপ্ট দু’টোই এত ব্রিলিয়ান্ট হয় যে আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে এই ছবিটা ডিরেক্ট করতে বলি। এক নারীর নিঃসঙ্গতা এক জন নারী যতটা সেনসিটিভলি বুঝতে পারবে, এক জন পুরুষের পক্ষে সেটা সম্ভবই নয়,” বলছেন কৌশিক।
প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতাও ‘নির্বাসিত’ নিয়ে যথেষ্ট উত্তেজিত।
“আমার কাছে এটা একটা মানবিক গল্প। সেটাই এই ছবিটার ইউএসপি। আমি এটাকে তসলিমার বায়োপিক হিসেবে একেবারেই দেখছি না।
এটা এক জন মানুষ আর তাঁর বেড়ালের গল্প— যে দু’টি প্রাণী ভীষণ লোনলি। আমি এর থেকে অনেক বড় ছবি করেছি। কিন্তু ‘নির্বাসিত’ ডেফিনিটলি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং,” বলছেন শ্রীকান্ত।
শ্রীকান্তের কাছ থেকেই জানা গেল, এই স্ক্রিপ্টটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছবিটা করবেন বলে সম্মতি জানিয়ে দেন।
“আমি যখন স্ক্রিপ্ট শুনি তখন শুধু দেখি পরিচালকের মাথায় ছবিটা পরিষ্কার আছে কি না। চূর্ণীদি যখন স্ক্রিপ্ট শোনাচ্ছিল, আমি জানতাম এই ছবিটা কেউ ডিরেক্ট করতে পারলে উনিই পারবেন। আর চূর্ণীদির যা পার্সোনালিটি, যা পড়াশুনো, তাতে এই চরিত্রটার প্রতি উনিই একমাত্র জাস্টিস করতে পারবেন। তাই ওঁকে আমি প্রধান চরিত্রে অভিনয়ও করতে বলি। আই ফিল প্রাউড, ভেঙ্কটেশ ফিল্মস এই প্রথম কোনও মহিলা ডিরেক্টরকে লঞ্চ করল। রিনাদি আমাদের সঙ্গে ছবি করেছেন, কিন্তু ফিমেল ডিরেক্টর হিসাবে লঞ্চ করলাম চূর্ণীদিকেই,” বলছিলেন শ্রীকান্ত।
কিন্তু যে লেখিকার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ নিয়েই নানা বাধা বিপত্তি, তাঁকে নিয়ে ছবি করা তো হাই-রিস্ক জোনে ঢোকা। নানা বাধা বিপত্তি কি এক্সপেক্ট করছেন চূর্ণী?
“দেখুন আপত্তি করলে তো যে কোনও জিনিস নিয়েই আপত্তি করা যায়। আমি শুধু এটুকুই বলব, আজকের দিনে আমরা সবাই ভীষণ নিঃসঙ্গ। নিজেদের চেনা পরিবেশে থেকেও সর্বক্ষণ নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে আমাদের। আমরা সবাই যেন ‘আইসোলেটেড’ কয়েকটা দ্বীপ। এটা তো ইউনিভার্সাল একটা ফেনোমেনা। ছবিটিতে এই নিঃসঙ্গতাটা দেখানোই আমার প্রধান কাজ। এটাই আমি কমিউনিকেট করতে চাই,” স্পষ্ট বলছেন চূর্ণী।
একই কথা বলছেন শ্রীকান্ত মোহতাও। “আমরা দুই নারীর একাকিত্বের গল্প বলছি। এক জন তসলিমা আর অন্য জন তাঁর বেড়াল। এটা হিউম্যান স্টোরি।”
হিউম্যান স্টোরি বলেই তো
নিঃসঙ্গ দুই নারী, তসলিমা আর মিনু আর একা নন।
তাঁদের পাশে এ বার চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়।
হ্যাঁ, পরিচালক হিসেবে। |
|
|
|
|
|