মোটরবাইকই ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ মালবাজারে
রাতের দিল্লি। ঝকঝকে রাস্তায় সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে সারি সারি গাড়ি। তার মধ্যেই একটি স্কুটিতে অন্য গাড়ির পাশ কাটিয়ে ছুটছেন এক কলেজ ছাত্র। তাঁর পিঠের সঙ্গে বাঁধা এক অসুস্থ বৃদ্ধ। পিছন থেকে তাঁকে ধরে রেখেছেন ওই ছাত্রের প্রেমিকা পিয়া।
ঠিক ধরেছেন। ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর র্যাঞ্চো আর পিয়া এই ভাবেই বন্ধুর বাবাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন হাসপাতালে। আর একটু দেরি করলেই যাঁকে বাঁচানো শক্ত হয়ে যেত।
জলপাইগুড়ির মাল ব্লকের ধলাবাড়ি গ্রাম থেকে এমনই ভাবে অসুস্থ মানুষকে নিজের পিঠের সঙ্গে বেঁধে মোটরবাইক করে হাসপাতালে নিয়ে যান করিমুল হক। দিনের পর দিন। রাত কিংবা ভোর। শীত হোক বা বৃষ্টি। একবার শুধু পেশায় চা বাগানের অস্থায়ী কর্মী করিমুলের মোবাইলে ফোন করাটা দরকার। মোটরবাইক নিয়ে সোজা চলে যান প্রত্যন্ত গ্রামে। রোগীকে গামছা বা কোনও কাপড় দিয়ে বেঁধে নেন নিজের সঙ্গে। পিছনে বসেন ওই রোগীর বাড়ির কেউ। যিনি পিয়ার মতোই রোগীকে ধরে রাখেন পিছন থেকে। এরপরে এবড়োখেবড়ো অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে করিমুল পৌঁছে যান কখনও মালবাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কখনও ৪৫ কিলোমিটার দূরে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে।
র্যাঞ্চো বন্ধুকৃত্য করেছিলেন। সুবর্ণপুর চা বাগানের অস্থায়ী কর্মী করিমুলের মুখের সামনে ভাসে তাঁর মায়ের মুখটা। বারো বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত মা-কে অর্থের অভাবে ঠিক সময় মতো চিকিৎসালয়ে পৌঁছে দিতে পারেননি। তাঁর কথায়, “তখন বেকার ছিলাম। এক রকম বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেলেন মা। সেই দিনটা ভুলতে পারি না।” তখনই শপথ নিয়েছিলেন, রোজগার করতে শুরু করলে যানবাহনের অভাবের জন্য এলাকার কাউকে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকতে দেবেন না। এখন দুই সন্তানের জনক করিমুল নিজের সংসার সামলে সেই শপথ পালন করছেন। তিনি বলেন, “উপার্জনের এক চতুর্থাংশ ধরা থাকে মোটরবাইকের জ্বালানি কিনতে।” তবে প্রসূতিদের তিনি কখনও মোটরবাইকে তোলেন না। করিমুলের কথায়, “রাস্তার ঝাঁকুনি যে কোনও রোগীর পক্ষেই খারাপ। কিন্তু প্রসূতিদের ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে। তাই আমি তাঁদের কখনও এই ভাবে নিয়ে যাই না। অন্যদের খুব সাবধানেই নিয়ে যাই।”
করিমুল হকের দু’চাকার অ্যাম্বুল্যান্স। ছবি: সুদীপ দত্ত
মাল ব্লকের রাজাডাঙা, ক্রান্তি, চ্যাংমারি বা কুমলাই গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশির ভাগ মানুষই করিমুলের এই মোটরবাইককেই ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ বলে চেনেন। বারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত মিলিয়ে এখানে প্রায় তিন লাখ মানুষের বাস। তবে ভরসা বলতে চারটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং মালবাজারে মহকুমা হাসপাতাল। তবে মাল পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের সদস্য পঞ্চানন রায় জানান, এলাকার বেশিরভাগ গ্রামেরই রাস্তা খুব খারাপ। মানুষও দরিদ্র। সাক্ষরতার হারও কম। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎও পৌঁছয়নি। তিনি বলেন, “এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে চার চাকার গাড়ি ঢুকবেই না। আবার অনেক জায়গায় রোগী অসুস্থ হলে গাড়ি ভাড়া করে তাঁকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্যও তাঁর পরিবারের নেই। সেক্ষেত্রে করিমুলই ভরসা। তিনিই রোগীদের পৌঁছে দেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।”
র্যাঞ্চো অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য অপেক্ষা করতে চাননি, তা হলে দেরি হয়ে যেত। মাল ব্লকে অ্যাম্বুল্যান্সই বাড়ন্ত। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক দীপকরঞ্জন দাস বলেন, “প্রসূতিদের জন্য একটি মাতৃযান ছাড়া সরকারি ভাবে কোনও অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা আমাদের ব্লকে নেই। তাই করিমুলের প্রতি আমরাও কৃতজ্ঞ।” তবে বিধায়ক তহবিলের টাকায় কেনা কয়েকটি অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা স্বপন সরকারের কথায়, “সব জায়গায় অ্যাম্বুল্যান্স যেতেও পারে না। পরিষেবার অভাব করিমুল একাই অনেকটা ঘুচিয়ে দিয়েছেন।”
মালবাজারের জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলি থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে খারাপ বা অন্ধকার রাস্তাই একমাত্র বাধা নয়। পথ আগলে দাঁড়ায় বুনো হাতির পাল বা বাইসন। এক দিন চেল নদী পার হতে এমনই অবস্থায় পড়ে অনেকটা ঘুর রাস্তায় যেতে হয়েছে করিমুলকে। ওই নদীর উপরে সেতু নেই। বর্ষাতে নদী পার হওয়া কষ্টকর।
তার মধ্যেই ডায়েরিয়া, সাপে কাটা, আগুনে পোড়া কিংবা হাত-পা ভাঙা রোগীদের নিয়ে পথ পেরিয়ে যান করিমুল। তাঁর স্ত্রী আরজু আরা বেগম বলেন, “বিয়ের আগে থেকেই জানতাম স্বামী লোকের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই মোটরবাইক কেনার সময়েও বুঝেছিলাম রোগীদের নিয়ে যাওয়ার জন্যই তা কিনছেন।” তাই তাঁর কথায়, “আমারই বরং স্বামীর মোটরবাইকে ওঠা হয় না। পরিবারের চেয়ে অনাত্মীয় রোগীদের প্রতিই স্বামীর ভালবাসা বেশি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.