ভাগ্যিস জোঁকগুলো ছিল!
এই জোঁকেরা রক্ত খাওয়াতেই গত আট বছর ধরে দুই পা রক্ষা পেয়েছে তুলসী পালের! ৮ বছর পর পায়ে আবার ক্ষত দেখা দিয়েছিল। তাই ফের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জোঁককে দিয়ে পায়ের রক্ত খাইয়েছেন, এবং আবার সুস্থ হয়েছেন। রাজ্যের একমাত্র আয়ুর্বেদ স্নাতক মেডিক্যাল কলেজ জেবি রায় হাসপাতালের চিকিত্সকেরা এই দাবিই করেছেন। ওই হাসপাতালে ভর্তি বছর বাহান্নোর তুলসীবাবু আর কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন। আপাতত এই কেসের সাফল্যকে সামনে রেখেই নতুন করে ‘জোঁক থেরাপি’ তে ফিরতে চাইছে সরকারি আয়ুর্বেদ হাসপাতাল।
আয়ুর্বেদে জোঁক থেরাপি-র ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো। শুশ্রূত-এর লেখাতেও এর কথা পাওয়া যায়। চিকিত্সার ভাষায় যার নাম ‘জলৌকা অবচারণ।’ জলৌকা অর্থাত্ জোঁক। মিশরের প্রাচীন চিকিত্সাতেও এর কথা রয়েছে। ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে শুধু চিকিত্সার জন্য ৪ কোটি জোঁক আমদানি করা হয়েছিল। কলকাতা শহরে ৩০-এর দশক অবধি রাস্তাঘাটে ডাক শোনা যেত, ‘জোঁক লাগাবে গো।’ ক্ষতস্থান, মাইগ্রেন, ত্বকের রোগ প্রভৃতিতে টাকা দিয়ে জোঁক কিনে লাগানো হত। কালক্রমে সেই প্রথা প্রায় লুপ্ত হয়, থেকে যায় শুধু আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বইয়ের পাতায়। |
কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রক আয়ুষ চিকিত্সার উপর নতুন করে জোর দেওয়ায় কিছুটা হলেও হাল ফেরে আয়ুর্বেদিক হাসপাতালগুলির। ঠিক সেই সময় থেকেই জোঁক থেরাপির মতো পুরনো চিকিত্সাপদ্ধতিগুলিকে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কলকাতা শহরে বসে সরকারি হাসপাতালে এখন দিব্যি পাওয়া যাচ্ছে জোঁকেদের কামড়। তুলসীবাবুর ক্ষেত্রে এই চিকিত্সা প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছিল ২০০৪ সালে। জে বি রায় হাসপাতালের কার্যনির্বাহী অধ্যক্ষ গোবিন্দচন্দ্র পোল্লের কথায়, পায়ের ধমনী দিয়ে রক্ত সঞ্চালন হচ্ছিল না তুলসীবাবুর। মারাত্মক ঘা হয়ে পা বাদ যেতে বসেছিল। দীর্ঘদিন এসএসকেএমের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগে চিকিত্সাধীন ছিলেন। তার পর গিয়েছিলেন ভেলোরে। সেখানে চিকিত্সকেরা বলেছিলেন প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে। অত টাকা ছিল না নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তুলসীবাবুর। অগত্যা সরকারি আয়ুর্বেদ কলেজের শরণাপন্ন হন। তারপরেই মুশকিল আসানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় জোঁকেরা।
কী ভাবে এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে নিতান্ত অকিঞ্চিত্কর এক প্রাণী? রক্তচোষা হিসাবে যার আবার প্রবল দুর্নাম?
চিকিত্সক গুপ্তেশ্বরনাথ উপাধ্যায়ের কথায়, কয়েক ধরনের জোঁক রয়েছে যারা শরীরের খারাপ রক্ত চুষে নেয় এবং ভাল রক্তের সংবহন স্বাভাবিক করে। তুলসীবাবুর দু পায়ের ক্ষতের উপর সপ্তাহে চার দিন চারটে করে জোঁক লাগিয়ে দেওয়া হত। তারা খারাপ রক্ত চুষে নিত। এই ভাবে তাঁর ধমনী দিয়ে হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হয় ক্ষতও সেরে যায়। আটবছর একেবারে সুস্থ ছিলেন। আবার রক্ত জমাট বাঁধা শুরু হওয়ায় চলতি মাসে আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। আবার শরন নেন জোঁকের। বারুইপুরের এক পুকুর থেকে বাছাই করে জোঁক ধরে আনেন জুনিয়ার ডাক্তারেরা। তাদের রক্ত খাওয়ার সুবাদে আবার এখন সুস্থ তুলসীবাবু। আর এই জোঁকেদের জন্য একপয়সাও খরচ হয়নি তাঁর। কারণ, জোঁকের দাম স্বাস্থ্য দফতরের ওষুধের তালিকায় ধরা নেই। এর কোনও দরপত্রও হয় না।
রাজ্যের আয়ুর্বেদিক চিকিত্সকদের আফশোস, জোঁকদের নিয়ে আরও একটু প্রচার হলে উন্নতমানের ‘ক্লিনিক্যাল জোঁক’ পাওয়া সুবিধাজনক হত। জোঁকের কামড়ে ব্যাথা হয় না। কেরল, গুজরাতের মতো একাধিক রাজ্যে এমন সংস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছে যাঁরা ক্লিনিক্যাল জোঁক সরবরাহ করে। এক-একটি জোঁকের দাম ৬০-১০০ টাকা। তাতে কাজ আরও ভাল হয়। বিদেশে এর চাহিদা আরও বেশি, বিশেষ করে প্লাস্টিক সার্জারিতে। কাটা অঙ্গ জোরা লাগানোর পর সেখানে ধমনীতে রক্ত সরবরাহ স্বাবাবিক করতে জোঁক বসানো হয়। ডেমি মুরের মতো হলিউড তারকাও খোলাখুলি শরীর সুন্দর ও তরতাজা রাখতে জোঁক থেরাপির ঢালাও প্রশংসা করেছেন।
চিকিত্সক পুলক করের কথায়, “ত্বকের রোগ, চোখের রোগ, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, স্ত্রীরোগেও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে জলৌকা আবচারণার পরামর্শ রয়েছে। ঠিকঠাক জোঁক জোগাড় হওয়ার পর তাকে হলুদ ডলে পরিষ্কার করতে হয়। রক্ত খাওয়া শেষ হলে সেই জোঁককে তুলে তার পিঠে অল্প চাপর মেরে আবার সেটা বমি করাতে হয়। না হলে খারাপ রক্ত খেয়ে জোঁকেরও অসুখ করবে যে। একই জোঁক একাধিক রোগীর শরীরে লাগানো হয় না। একবার রক্ত খাওয়ার সাত দিন পর সেই একই জোঁককে আবার চিকিত্সায় ব্যবহার করা যায়।
এ হেন জোঁকেদের নিয়ে তুলসীবাবুর কী বক্তব্য? একমুখ হেসে তিনি বলেন, “বেঁচে থাক বাবা-রা!” |