একটা যুগ ছিল যখন বাংলা গানের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে অনেকেই গান শেখাতেন। সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন, নীতা সেন এবং আরও অনেকে। সকলে সমান নাম করতে পারেননি। আমি তার পরের যুগের লোক। সবার নামও জানা নেই। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়েছিলেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৭ আর ১৯৬৮ সালে আমি নিজেও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে যেতাম। কিন্তু আমি তো আর সে-যুগে নাম করা কেউ ছিলাম না। তখনও আমি নিতান্তই শিক্ষানবিশ। বেতারে গান গাইতাম, কিন্তু সেকালের ‘বেতারশিল্পী’দের মধ্যে আমি ছিলাম সম্ভবত সবচেয়ে ওঁচা। আমার চেয়ে ঢের ভাল গাইতেন সুবাস মিত্র ও কবি মজুমদার। দু’জনেই আমার চেয়ে বয়সে বড়। গায়কিতেও। অনুপ ঘোষালও আমার চেয়ে ভাল গাইতেন। আমি বোধহয় জন্মেইছি নিজের অক্ষমতার নিরিখে অন্য শিল্পীদের ক্ষমতার মাপ নেব বলে। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও গান শেখাতেন। তাঁদের প্রশিক্ষণে আমরা ভাল ভাল শিল্পী পেয়েছি। কিন্তু আমার মতো শিক্ষার্থীই ছিলেন বেশি আমাদের বাংলায়: এক দিকে গান শেখার অদম্য উৎসাহ, অন্য দিকে ক্ষমতা ও গায়ন-প্রতিভার অভাব।
চল্লিশের দশকেই এমন অন্তত দু’জন শিল্পী গান শিখতে শুরু করেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে, যাঁরা তাঁদের মান বজায় রেখে অনেক দিন গান গেয়ে গিয়েছেন: পান্নালাল ভট্টাচার্য ও সনৎ সিংহ। শুনেছি সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিন জনেই নিয়মিত বেতারে গান গেয়েছেন, গ্রামোফোন রেকর্ডও করেছেন। একই গুরুর কাছে গান শিখেও তিন জনের শিল্পী-ব্যক্তিত্ব কিন্তু আলাদা। এখানেই বোধ হয় আমাদের দেশের ধ্রুপদী সংগীতশিক্ষার থেকে আধুনিক সংগীতশিক্ষার সাংস্কৃতিক তফাত। ধ্রুপদী সংগীতের একই গুরুর ছাত্রছাত্রীরা মোটের ওপর সকলেই গুরুর গায়কি বা বাজনার আঙ্গিক অনুসরণ করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে একেবারে আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে সংগীতজগতে দাঁড়াতে পারেন কম শিল্পীই। আধুনিক সংগীতে কিন্তু একই গুরুর কাছে শিখে বা শিল্পী-জীবনের প্রথম দিকে কোনও বড় শিল্পীর প্রভাবে আচ্ছন্ন থেকেও কালক্রমে আলাদা ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে পেরেছেন অনেকেই।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শিল্পী-জীবনের প্রথম দিকটায় তাঁর গায়কিতে ছিল পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রভাব। পঞ্চাশের দশক থেকে যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমরা পাচ্ছি, তিনি তাঁর নিজের গায়কি তৈরি করে নিয়েছেন।
শ্যামল মিত্রের প্রথম দিকের গ্রামোফোন রেকর্ডগুলিতে তাঁর গুরু সুধীরলালের গায়কির প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই তাঁর গাওয়ার ধরন সেই প্রভাব-মুক্ত। উৎপলা সেন ও নীতা সেন দু’জনেই সুধীরলালের ছাত্রী। গায়কি কিন্তু আলাদা। কণ্ঠ ও গায়নশৈলীর দিক দিয়ে উৎপলা সেন গোটা উপমহাদেশেই অদ্বিতীয়া। |
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো কণ্ঠসম্পদ (তিন সপ্তকেই যাঁর কণ্ঠের একই গরিমা), পুরাতনী, বৈঠকি ও কীর্তন থেকে খেয়াল-ঠুংরি-গজল ধরে আধুনিক পর্যন্ত নানান আঙ্গিকের গানে এমন দখল আর দাপট উপমহাদেশের আর কোনও শিল্পীর মধ্যে পেয়েছি কি আমরা? কিন্তু উচ্চারণ! এমন অলৌকিক যাঁর কণ্ঠের ক্ষমতা, এমন নিশ্ছিদ্র যাঁর গায়কির আধুনিকতা, তাঁর উচ্চারণে এ কী সাবেকিয়ানা! ‘এইটুকু’টা ‘এয়টুকু’, ‘গেয়ে’টা ‘গেইয়ে’। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মহাশিল্পীর আরাধনা করে যাব, কিন্তু উচ্চারণের এই বেখাপ্পা অনাধুনিকতার জন্য খেদও করে যাব।
তাঁর কাছে গান শিখেও পান্নালাল ভট্টাচার্য ও সনৎ সিংহ কিন্তু তাঁদের উচ্চারণে গুরুর প্রভাব ঢুকতে দেননি। পান্নালাল শ্যামাসংগীতশিল্পী হিসেবে বেশি খ্যাতিমান হয়ে উঠলেও আধুনিক গানেও তিনি অসামান্য। তাঁর গাওয়া আধুনিক গান ‘ও আমার কাজল পাখি’ শুনলে আমার আজও মনে হয় অমন গান শোনার পর আমার অন্তত গানের দুনিয়ায় আসা উচিত হয়নি।
নিয়মিত বেতার ও রেকর্ড-শিল্পী হয়েও সনৎ সিংহ থেকে গিয়েছেন কাব্যে উপেক্ষিত। আচার্য চিন্ময় লাহিড়ির কাছে ধ্রুপদী সংগীতেরও তালিম নেওয়া সনৎ সিংহ নানান ধরনের সুরতালছন্দ সামলে গান গেয়ে গিয়েছেন অনায়াসে, অনেকগুলি বছর ধরে। পান্নালালের মতো তাঁর গায়কিতেও কোনও দিন কোনও জোরালো চেষ্টার ছাপ ছিল না। এ দিক দিয়ে তাঁরা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সমগোত্রীয়। সহজ সাবলীল গায়কি।
পাঁচ-ছ’বছর বয়সে কটক থেকে কলকাতায় এসে প্রথমেই বেতারে যে বাংলা গানগুলি শুনেছিলাম, তার মধ্যে ‘অহল্যা কন্যা ঘুম ঘুম কি ভাঙবে না গো ভাঙবে না’ আর ‘যমুনাকিনারে শাজাহানের স্বপ্নশতদল’ সবচেয়ে ভাল লেগেছিল। দ্বিতীয়টির শিল্পী মৃণাল চক্রবর্তী। প্রথমটি রেকর্ড করেছিলেন সনৎ সিংহ। যেমন মজাদার সুর, তেমনি গাওয়া। অমন গাওয়া না হলে সুরের মজা বুঝব কেমন করে। পরে জেনেছি, সুরকার ছিলেন নচিকেতা ঘোষ, যাঁর কিছু-কিছু সুর শুনলে মোৎসার্ট ও শুবার্টও সম্ভবত এক মুখ হেসে বলতেন ‘আপনাকে মানলাম, মশাই’। সাবলীল গায়কিতে কোথায় যেন একটা স্ফূর্তি ছিল, যে-ধরনের স্ফূর্তি আমি তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়কিতে পেতাম। ‘ঘুম ঘুম কি ভাঙবে না গো ভাঙবে না’ এই অংশে সনৎ সিংহ তাঁর গলায় তুলেছিলেন ছোট ছোট দু’টি ঢেউ, পরিমিত ভঙ্গিতে। এক চুল বেশি হলেই বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারত। অন্তরায় গানটিতে খরজ পরিবর্তন, একেবারে পাশ্চাত্য সংগীতের নিয়ম মেনে, অর্থাৎ মূল ষড়জের শুদ্ধ মধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে অন্তরার ষড়জ। ষড়জের অবস্থানগত পরিবর্তন সুরে যে নতুনত্ব ও তীব্রতা আনল, সনৎ সিংহ তাঁর কণ্ঠে এত আনন্দের সঙ্গে তা ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে ওই জায়গাটা শুনলেই আমার ছ’বছরের মনটা নেচে উঠত।
ছোটবেলায় শোনা গানগুলির মধ্যে আর একটি ছিল ‘সার্কাস’। সনৎ সিংহ। গানটি ছোটদের জন্য হতে পারে কিন্তু বড়দের শুনলেও খুব ভাল লাগার কথা। খাঁটি সুরেলা গলায় কী সহজ করে গেয়েছিলেন তিনি সেই গান, অথচ সুর ছিল রীতিমত দুরূহ। অন্তরায় এক লাফে তারসপ্তকের মধ্যম। তার দু’লাইন পর হঠাৎ তারসপ্তকের কোমল গান্ধার। সঞ্চারীতে অদ্ভুত এক সুরের প্যাঁচ। সব কিছুই কী অনায়াসে গেয়ে দিয়েছেন! সনৎ সিংহ সেই গোত্রের গায়ক, যিনি অনেক অঙ্ক সহজ করে বুঝিয়ে দিতে জানতেন। তাঁর গান শুনে বরাবর মনে হয়েছে ও মা, এত সহজ? গুনগুন করে গাইতে গিয়ে টের পেয়েছি গানটা তোলা কী কষ্টকর। ‘বাবুরাম সাপুড়ে’র ‘আয় বাবা দেখে যা’-এর ‘যা’ থেকে ‘দুটো সাপ রেখে যা’-র ‘দুটো’-র মধ্যে মাত্র এক মাত্রায় তীব্র মধ্যম থেকে শুদ্ধ মধ্যমে একটা ফিরে-আসা আছে, ছোট্ট একটু ঝোঁক সমেত। শুধু এইটুকু কত জন পারেন, তার একটা পরীক্ষা হলে আমি অন্তত বিপদে পড়ব।
সুর ও ছন্দের বিচিত্র চলনের মোকাবিলা সনৎ সিংহ করতে পেরেছেন কুলকুচো করার মতো সহজে। সম্ভবত নচিকেতা ঘোষের সুরে, ‘সাপুড়ের পাঞ্জা দোলে’ গানটিতে বেশ জটিল স্বরের সমাহার। ঢিমে আট মাত্রার ছন্দে সাপের ফণার দুলুনির ভাব। কী অব্যর্থ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সনৎ সিংহ! তেমনই রম্যগীতিতে সনৎ সিংহ ও মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া, প্রবীর মজুমদারের সুরে—
‘ভানুমতীর ভেলকি লাগে
শিয়রে মা মনসা জাগে
এনেছি হরেক রকম সাপের খেলা
আমরা বেদে বেদেনি...’।
কী বিচিত্র সেই সুর ও ছন্দ! আধুনিক বাংলা গানের ব্যাপারে শিক্ষিত সমাজের উন্নাসিকতার কারণে সংগীতের অনেক সেরা সৃষ্টি বরাবর উপেক্ষিত। বাংলার অনেক ভাল শিল্পীও। |