ফ্ল্যাত করে এসে পড়ল টেবিলের ওপর, তার পর সেটা থেকে গজিয়ে গেল অসংখ্য পা, মাথা, কিলবিল করে উঠল ফুটি ফুটি দেওয়া শরীর, সেটা জেলির মতো এ দিক ও দিক করে চলতে লাগল... উফ্ফ্ফ্ফ্!!!! অসহ্য... আমার খুব গা গুলোয়, সারা শরীর কেমন চুলকোতে থাকে, আনচান করে ওঠে আত্মা, আর কেমন যেন মনে হয় আমি আর কিছু ক্ষণ এ সব দেখতে দেখতে, ঠিক ওই রকমই হয়ে যাব। ঘাড়ের পাশ দিয়ে কেমন একটা ঠান্ডা ভাব নেমে যায়। সেটা কি ভয়? বিস্ময়? বিদেশি সিনেমার স্পেশাল এফেক্টের প্রতি শ্রদ্ধা? একটু ভাবতে ভাবতে বোঝা যায়, সে সব কিচ্ছু নয়, নিখাদ ঘেন্না।
ভিন গ্রহ থেকে আসা এই প্রাণীগুলো আমার জিনা হারাম করে রেখেছে। দু চক্ষের বিষ এই সায়েন্স ফিকশন-এর চরিত্ররা। কিলবিলে ভাবটাই আমার মেন ভিলেন হয়ে ওঠে। আর সিনেমা শেষ হলেই তো যন্ত্রণাটা শেষ হচ্ছে না। রাত্রে শুতে গিয়ে মনে হবে, হাজারটা চোখ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে। পাশ ফিরতে গিয়ে মনে হবে, নিশ্চয়ই ফ্যাত শব্দে কিছু একটা আমার হাতেই চটকে গেল। কী বিড়ম্বনা। আমি কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারি না। কখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, কখনও ঘিনঘিন করে। খাওয়ার সময় তো আরও ঝকমারি। মনে হয় আমার হাতে কারও শুঁড় জড়িয়ে রয়েছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আর দেখেছি, যত অদ্ভুতুড়ে চেহারা, তত যেন কদর বেশি। যত হ্যালহ্যালে, ল্যাল্ল্যালে জিনিস কারও পেট ফুঁড়ে বেরোচ্ছে, কারও হাতের ভেতর থেকে হাত ফুলিয়ে বেরোচ্ছে, কারও চোখের কোনা দিয়ে বেরোচ্ছে, তত যেন সিনেমা হিট। যদি ভিন গ্রহের বাসিন্দা আর হিরো মার্কা সিক্রেট এজেন্ট না থাকত, গোটা হলিউড কী নিয়ে সিনেমা করত কে জানে। যখনই টিভিতে ইংরেজি সিনেমার চ্যানেল ঘোরাও, হয় দমাদ্দম গুলি চলছে, নয় প্রচুর আলো জ্বালিয়ে মহাকাশযান এসে জঙ্গলে ল্যান্ড করছে।
যারা সিনেমা বোঝে, সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করে, ওই সব সিনেমার মধ্যে সাংঘাতিক সামাজিক মেসেজ খুঁজে পায়, তারা আমায় এই নিয়ে কম কটু কথা শোনায়নি। অনেকের মনে হয় এটা ন্যাকামি। একটু বেশি মেয়েলি ভাব দেখানো। কিন্তু পাড়ার মোড়ে তিনটে মাথাওলা বাছুর দেখতেও যেমন কখনও যেতে পারিনি, তেমনি হাজার শুঁড়ওলা তেত্রিশশো চোখওলা ভিনগ্রহের প্রাণীকে আপন করে নেওয়াও আমার পক্ষে অসম্ভব। এই যে জনি ডেপ-এর যে বিখ্যাত সিনেমাটা এল, ‘পাইরেট্স অব দ্য ক্যারিবিয়ান’, তার অহরহ ট্রেলর দেখে তো শরীর খারাপ লাগত। কে চরিত্র, কী চরিত্র আমার জানার বিন্দুমাত্র দরকার নেই, কিন্তু এক জনকে দেখাত তার মুখের কাছে অসংখ্য শুঁড়, কথা বললেই হিলবিলিয়ে উঠছে। কী গা রি-রি করত কী বলব। তার পর ‘মেন ইন ব্ল্যাক’। উইল স্মিথকে প্রাণ ভরে দেখব বলে বসেছি, ব্যস, অতিকায় আরশোলা আর সব্জেটে সব বীভৎস প্রাণীর মেলা বসে গেল!
জানি না ভিন গ্রহের বাসিন্দাদের এত সরাসরি ঘেন্না করার কথা বলা খুব পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হল কি না। চেহারা দেখে প্রাণিগুলোকে খারাপ ঠাউরে নেওয়া ওদের পক্ষে অপমানজনক নিশ্চয়। লোকগুলোকে খারাপ আমি বলছি না অবশ্য, কিন্তু জীবদ্দশায় ওদের ভালবাসতে পারব বলে মনে হয় না। তাতে আমার খুব ক্ষতি নেই। আমার জীবন মনে তো হয় ওদের ছাড়া দিব্যই চলবে। কেবল এক জনের কথা না বললেই নয়। যাকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। সে আমারও সত্যিকারের বন্ধু, আমার প্রিয় জন, আমার ছোট বেলার গলা বুজে আসার অন্যতম কারণ। আমার ই.টি.। |