ভোরের আপ ক্যানিং শিয়ালদা লোকাল। রোজ নিয়ে আসছে দলে দলে ‘কাজের লোক’।
তাঁদের অমর্যাদার ভাগী হয়ে তার নামটিও বিশ্রী।
সুস্নাত চৌধুরী |
থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান থ্রি। থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান ফাইভ। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ফুটানিকে এক ধাক্কায় শুইয়ে দিতে পারে এই দু’টি সংখ্যা। অন্তত সাউথ ক্যালকাটা বলতে যে দক্ষিণ কলকাতাটিকে বোঝানো হয় ‘এলিট’, ‘পশ’ এ সব বিশেষণ যে স্থানবাচক বিশেষ্যর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি আয়তনে ফুলে-ফেঁপে দ্রুত বাড়তে থাকা সেই বেলুনটিকে ছোট্ট আলপিনের মতো নিমেষে ফুস করে চুপসে দিতে পারে ওরা।
আপ ক্যানিং-শিয়ালদা লোকাল। লোকে বলে ‘ঝি লোকাল’। ‘লোকে’ মানে, যাঁরা কলকাতায় থাকেন। পয়সা দিয়ে যাঁরা ‘ঝি’ রাখতে পারেন, সেই সব দাদা-বউদিদের কাছে এটাই ট্রেনগুলির ডাকনাম। আদরের। এমন ট্রেন অবশ্য আরও দু-তিনটি আছে। ভাবলে অবাক লাগে, চোখে না দেখলে ঠাহর হতে চায় না, গোটা একটা ট্রেন, বগির পর বগি, ঠাসা ‘কাজের লোক’-এ। কাজের মাসিতে, কাজের দিদিতে। এক-দেড় ঘণ্টার রেলপথ পেরিয়ে রুজি-রুটির সন্ধানে তাঁদের শহরে আসা।
ঘুম থেকে ওঠা প্রায় মধ্য রাতে। চটজলদি নিজের ঘরের কিছু কাজ সেরে ফেলা। তার পর বেরিয়ে পড়া। অটো কিংবা ভ্যান। না পোষালে, পায়ে পায়ে স্টেশন। ধরতে হবে চারটে বত্রিশের আপ ক্যানিং-শিয়ালদা লোকাল। না হলে, তার পরের গাড়ি, পাঁচটা কুড়ি। এদেরই নম্বর দুটো গোড়ায় লিখলাম। কিন্তু রাত সাড়ে তিনটের আগে থেকেই একটু একটু করে ভিড় বাড়তে থাকে ক্যানিং স্টেশনে। যাঁদের মান্থলি নেই, সেই সব ‘ডব্লিউ টি’-দের জন্য একেবারে প্রথম ট্রেনটিই সেফ। তিনটে পঞ্চাশ। থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান ওয়ান।
সকলের পরনেই ছাপা শাড়ি। একটু ন্যাতানো, যেন কথা শুনবে। চটজলদি কাজে সুবিধে হবে। আর প্রায় প্রত্যেকের হাতেই একটা করে নাইলনের থলি। যেন ইউনিফর্ম। কে জানে, কী থাকে তার ভেতর! তার পর ট্রেনে উঠে বসে পড়া। ক্যানিং থেকে উঠলে তবু বসার জায়গা মেলে। পরের স্টেশন তালদি থেকে রে-রে করে আরও এক দল। তখন কামরায় কামরায় গাদাগাদি ভিড়। কেউ মেঝেতেই বসে পড়েন। কেউ কোনও মতে দাঁড়িয়ে। ঘড়িতে তখন ভোর চারটে আটত্রিশ কিংবা পাঁচটা ছাব্বিশ। গোটা ট্রেনটা তখন বাইরে থেকে দেখতে মেয়েদের স্কুলবাসের মতো। শতকরা পঁচানব্বই জন মহিলা। গড়পড়তা একই ছাঁচে ঢালা। প্রায় প্রত্যেকেই চলেছেন অন্যের বাড়ি ‘ঝি-গিরি’ করতে।
ঢুলুনি চলছে, কলকল কথাও। ‘আমার চায়নার মোবাইলে কী জোস্সে অ্যালাম হয়!’ এক-একটা ডায়লগ শুনে মনে হয়, কত ভেবে খাপে-খাপ বসিয়েছেন চিত্রনাট্যকার! আবার, ‘চা করে গালে তুলে দিতে হয় গা!’ ভাবি, এই খিস্তি কাকে? যাঁকে ঘরে রেখে এলেন, তাঁকে? না, যাঁর বাড়ি যাচ্ছেন, তাঁকে?
অনেকেরই স্বামী কিছু করেন না। বা যেটুকু করেন, সংসার চলে না। কেউ মুরগির দোকানে মুরগি কাটেন, বদলে মাইনে নেন না। প্রত্যহ দু’বোতল চোলাই নেন। কেউ ছোটখাটো দোকান চালান, কেউ লক-আউট হওয়া কারখানার ‘প্রাক্তন’ শ্রমিক। সুতরাং, নিজের সংসারের দায়িত্ব এঁদের তুলে নিতে হয়েছে নিজের কাঁধেই। উপায় একটাই ট্রেনে চড়ে বসা। ঝি লোকাল। ঝি লোকাল তাঁদের ভাত দেবে। ঝি লোকাল তাঁদের সন্তানকে বড় করার খরচ জোগাবে। তাঁর আদরের সোয়ামিটিকে, যে তাঁকে হপ্তায় অন্তত দু’দিন মদ খেয়ে বেদম পেটায়, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে, তাঁর ওষুধ কিনে দেবে। এই যে এক-ট্রেন নারী, এঁরা ফেমিনিজ্ম-এর নাম শোনেননি কোনও কালে। মাথার ওপর ঘোমটা দেওয়া উচিত কি না, বুকের ওপর ওড়না অপমানকর কি না, ‘মেয়েছেলে’ শব্দটা অশালীন কি না এ সব প্রশ্ন, বিতর্ক এঁদের থেকে শত হাত দূরে কোথাও হচ্ছে হয়তো। এঁদের জীবনে মোমবাতি মিছিল নেই, শাহবাগ নেই। কিন্তু, সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য এঁদের কোনও লেডিজ কম্পার্টমেন্ট লাগে না, নির্ধারিত লেডিজ সিট লাগে না, শতাংশের হিসেবে সংরক্ষণ লাগে না। লেডিজ স্পেশাল ‘মাতৃভূমি লোকাল’ নয়, এঁরা জানেন প্রতি দিন কী ভাবে দুটো-তিনটে সাধারণ লোকাল ট্রেনকেও এই পুরুষতন্ত্রের মাঝখান থেকে হাইজ্যাক করে ‘ঝি লোকাল’ বানিয়ে ফেলা যায়!
আপনি যদি ‘ভদ্রমহিলা’ হন, কিংবা পুরুষ হন, ভদ্র বা অভদ্র যে কোনও শ্রেণির এই ট্রেনে উঠলে কিঞ্চিৎ ভয়-ভয় করবে। হংসমধ্যে বকো যথা আপনি কোথা থেকে এলেন, কোথায়ই বা যাবেন, গুলিয়ে যেতে থাকবে। এতটাই পাওয়ারফুল, প্রায় অ্যাগ্রেসিভ ওঁদের বডি-ল্যাংগোয়েজ। দিনরাত এতখানি লড়ে নিতে হলে সেটা বোধহয় বাধ্যতামূলক ভাবেই আসে। হয়তো ওঁরাও আপনাকে সন্দেহের চোখে নজর করবেন। ‘আপনার তো এখানে থাকার কথা ছিল না’ গোছের অর্থ সে চাউনির। কে জানে, শ্রেণিশত্রু হিসেবেও দেখতে পারেন। একটু আড়ষ্ট হয়ে, ওঁদের চোখে চোখ না দিয়ে, মাথা নিচু করে বা মুখ ঘুরিয়েই কাটবে আপনার রেলযাত্রা।
কানও আপনি খুলে রাখতে পারবেন না। কেননা ওঁদের আলোচনাও আপনার মরমে পশিবে। বার বার উক্ত ‘মুকাজ্জিবাবু’ কি ‘চ্যাটাজ্জিবউদি’-র সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ফেলবেন। ‘কত বার বল্লাম, তবু একটা কবেকার কাপড় দিল, স্সাড়ি না ন্যাকড়া!’ অথবা ‘দ্যায় তো দু-কানা রুটি, তাও যেন সুক্নো চামড়া। বলে দিইচি টিপিন লাগবে না, একসো টাকা বাড়িয়ে দিন। তার বেলা রাজি হচ্চে না, স্ল্লা হারামি!’ আপনার রুচিশীল কান লাল হয়ে উঠবে। কিন্তু, ওঁরা নাগাড়ে উগরে দিতে থাকবেন নিজেদের ক্ষোভ। স্পষ্ট ভাষায় মনিবের সমালোচনা, মালকিনের কাটাছেঁড়া। স্বাভাবিক। ওই ট্রেনই ওঁদের প্রতি দিনের টিম মিটিং-এর ক্লাব হাউস, রোজকার রঁদেভু।
তার পর ওঁরা নেমে পড়বেন বাঘা যতীন কি যাদবপুর স্টেশনে। পিছু ফিরে না তাকিয়ে সার বেঁধে হনহন করে এগিয়ে যাবেন। সংসার টানতে অন্তত চার-পাঁচ বাড়ি কাজ করতেই হয়। কারও ঠিকে কাজ, কারও কাজ রাঁধুনির। একটার পর একটা। মধ্যবিত্ত গেরস্তর কাছে এঁরা নেসেসারি ইভিল। ভদ্দরবাবুবিবি এঁদের গিলতে পারেন না, ওগরাতে তো নয়ই। এক দিন কামাই হলেই ত্রাহি ত্রাহি রব। লাইনে ফাটল দেখা দিলে রেলমন্ত্রীর গুষ্টি উদ্ধার। ইলেকট্রিক তারে কলাপাতা পড়লে রাজনৈতিক রংবাজির বাপ-মা তোলন। শিক্ষিত আধুনিক বাঙালির এই ‘ঘরোয়া’ বিপ্লব নীতির প্রশ্নে নয়, জাস্ট আজ কাজের লোক আসবে না বলে! বালিগঞ্জ, যাদবপুর, গড়িয়া দক্ষিণ কলকাতার একটা বড় অংশ সে দিন টলমল করে। ঘরদোর আলুথালু পড়ে থাকে। অফিসে লেট হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না হয়তো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা শহর থমকে যায়, স্রেফ দুটো ট্রেন মাঝরাস্তায় আটকে পড়েছে বলে!
অথচ এঁদের কাজকে কেউ এতটকু সম্মান দিতে রাজি নন। ‘ঝি লোকাল’ শব্দবন্ধটিও সেই অমর্যাদার বোধকে বহন করে। বাড়ির কিছু খুঁজে না পাওয়া গেলেই প্রথম সন্দেহ কাজের লোকের ওপর। বিনা দ্বিধায় তো বটেই, বিনা প্রমাণেই চলে জিজ্ঞাসাবাদ, চোটপাট। আবার, তাঁদের রোজগারকেও স্বীকৃতি দেয় না এ সমাজ। জিডিপি-তে এর কোনও উল্লেখ থাকে না। এত সব অপ্রাপ্তির হিসেব অবশ্য ওঁরা কষেন না। নাকমুখ গুঁজে কাজ করতে করতে কখন দেড়টা-দুটো বেজে যায়। আবার ফেরার ট্রেনের জন্য পা চালানো। ডাউন শিয়ালদা-ক্যানিং লোকাল। না, এই ট্রেনগুলো তখন আর ঝি লোকাল নয়। তখন ঘরে ফিরছে লক্ষ্মী। সে কারও ঘরের মেয়ে, কারও ঘরের বউ। |