রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
ছোট লাইনের ট্রেন
মামার গাড়ি
ভাই সকল, তোমরা সব তাড়াতাড়ি মামার গাড়িতে উঠে পড়ো। আর দেরি কোরো না। কোথায় গেলে দিলীপ বেঙ্গসরকর! কোথায় গেলে মনোজ প্রভাকর! আর রবি শাস্ত্রী কি এখনও ঠুকঠুক করে হেঁটে বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত আসতে পারল না? মামার গাড়িকে আর কত ক্ষণ প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে রাখব বলো তো? এ গাড়ি চলে গেলে কিন্তু বাসভাড়া দিয়ে খেলার মাঠে আসার দায়িত্ব তোমার। আমাদের ক্যাপ্টেন ট্রেনের কামরার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতাটি পেশ করল। আমরা জ্ঞানদাস কাঁদরার মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছি। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। কিন্তু উত্তেজনা তুঙ্গে। কাঁদরার সংগঠক বলে দিয়েছে নিজের দায়িত্বে আসতে হবে। তবে বিকেলে খেলার পর মুড়ি, বেগুনি আর দুটো আলুর চপ ফ্রি। নিজের দায়িত্বে খেলতে গেলে ছোট লাইনের ট্রেনের চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? ভাড়া দিতে হত না, তাই আমরা বলতাম মামার গাড়ি। রবি শাস্ত্রীও হাঁপাতে হাঁপাতে চলে এল। দেরি হচ্ছিল কারণ জেঠুর পা টিপতে হচ্ছিল। মামার গাড়িতে চেপে সোজা মাঠে। খেলার শেষেও ফিরতি বাহন সে-ই। রাতে অন্ধকার কামরায় বিড়ি খেতে খেতে সেলিব্রেশন।

কবি সম্মেলন
নতুন আইডিয়াটা দিয়েছিল আমাদের পাড়ার রঘুদা, মানে রাঘব মল্লিক। যে কবির যেখানে বাড়ি, সেখান থেকে উঠে পড়বে ইঞ্জিনের পরের কামরায়। কেউ উঠবে কাটোয়া থেকে, কেউ চারকলগ্রাম থেকে। কেউ কীর্ণাহার থেকে, কেউ লাভপুর থেকে। ইঞ্জিনের পরের কামরার গায়ে কে যেন রসিকতা করে লিখে দিয়েছে ‘কবি স্পেশাল’। রবিবার সকাল আটটায় ট্রেন ছাড়বে কাটোয়া থেকে। স্পেশাল কামরায় অন্য কোনও লোক ওঠার চেষ্টা করলে কবিরা মারধর করবে না ঠিকই, কিন্তু হাত জোড় করে অনুরোধ করবে, দাদা প্লিজ অন্য কামরায় উঠুন। সবুজ ধানখেতের মধ্যে দিয়ে যখন ট্রেন যাবে, হাওয়া খেতে খেতে চলবে কবিতা পড়া। মাঝে মাঝে স্টেশনে গরম চা আর পেঁয়াজি। যখন ট্রেন যাবে লাঘাটার ব্রিজের ওপর দিয়ে, যখন ট্রেন যাবে ফুল্লরা মায়ের মন্দিরের পাশ দিয়ে, যখন ট্রেন যাবে লাল মাটির ওপর দিয়ে, তখন যদি কারও মনে নতুন কবিতা আসে, ট্রেনের দুলুনির মধ্যেই তক্ষুনি পটাপট লিখে ফেলবে, আর টক করে পড়ে শুনিয়ে দেবে। কাটোয়া থেকে আহমেদপুর। ফের আহমেদপুর থেকে কাটোয়া। মোট পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টার মেয়াদে কাব্যসফর।
অদ্ভুত সাইকেল চালক
ছোট লাইনের ট্রেনে করে আসবে সাইকেল চালক। আমরা অধীর আগ্রহে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছি। যে-সে সাইকেল চালক নয়। মাটি না ছুঁয়ে সাইকেলের ওপর টানা তিন দিন থাকবে। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কাজ সব কিছু তিন দিন সাইকেলেই হবে। সাইকেল চালিয়ে নানা কেরামতিও দেখাবে। কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। কেন দেরি করছে কেউ জানে না। শেষে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ট্রেন অনেক ক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দাশকলগ্রাম স্টেশনে। সেখানে কী ভাবে যেন খবর চলে গিয়েছে কীর্ণাহারে আসছে সেই অদ্ভুত সাইকেল চালক। গ্রামবাসীরা সাইকেল চালককে পাকড়াও করেছে। ট্রেনের কামরা থেকে টানা-হ্যাঁচড়া করে তাকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে এনেছে। তাদের দাবি, ট্রেন দাঁড় করিয়ে সাইকেল চালকের কয়েকটা কেরামতি প্ল্যাটফর্মের ওপরেই দেখাতে হবে। অন্তত সাইকেল চালাতে চালাতে মাথার ওপর স্টোভ জ্বালিয়ে ডিম ভাজার খেলাটা তো বটেই। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, কখন ডিম ভাজা শেষ হবে। ট্রেন চালকও সেই কেরামতিতে মজে রয়েছে। প্যাসেঞ্জাররাও। শেষ পর্যন্ত ট্রেন যখন কালো ধোঁয়া উড়িয়ে কীর্ণাহারে পৌঁছল, দু’ঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। দেখি সাইকেল চালক ট্রেন থেকে নামছেন, গলায় টাকার মালা। তক্ষুনি ট্রেনের চালকও ইঞ্জিন থেকে নেমে ওই টাকার মালায় সেফ্টিপিন দিয়ে একটা দশ টাকার নোট লাগিয়ে দিলেন।

বেদের মেয়ে জোস্না
রেল স্টেশনের কাছেই টিনের চালের ভিডিয়ো হল ‘ড্রিম কর্নার’-এ লেগেছে ‘বেদের মেয়ে জোস্না’। কাতারে কাতারে দর্শক ছোট লাইনের ট্রেনে করেই আসছেন দেখতে। আশপাশের ছোট ছোট গ্রাম থেকে দর্শকদের একদম বিনা পয়সায় ওই ট্রেন পৌঁছে দিচ্ছে ভিডিয়ো হলের দোরগোড়ায়। সবথেকে বেশি ভিড় হয় ইভ্নিং শো-য়। কারণ ওই সময়েই একটা ট্রেন কীর্ণাহারে আসে। ট্রেন একটু দেরি করে এলে ড্রিম কর্নারে শো শুরু হতেও দেরি। ট্রেন কখন আসছে সেই নিয়ে চিন্তায় থাকেন হলের মালিক। এ দিকে বেদের মেয়ে জোস্নার সাফল্য দেখে ড্রিম কর্নারের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘লাইট হাউস’-এর পরবর্তী আকর্ষণ ‘অন্যায় অবিচার’। ট্রেনেই শুরু হয়েছে জোর প্রচার।

একটু উষ্ণতা
প্রবল ঠান্ডা পড়েছে। ঠান্ডায় থরথর কাঁপছে বীরভূমের গ্রাম। ট্রেন যখন গ্রামের মধ্যে দিয়ে যায়, গ্রামবাসীরা লাইনের ধারে ভিড় করে। ট্রেন চালকের কাছ থেকে কয়লা চায়। রাতে ওই কয়লা জ্বালিয়ে একটু আগুনে সেঁকে নেবে তাদের শরীর। ট্রেনের চালক ট্রেনের গতি আস্তে করে দেয়। ইঞ্জিন থেকে কিছুটা কয়লা বেলচা দিয়ে তুলে রেল লাইনের ধারে ফেলে দিয়ে চলে যায় ট্রেন।

বনলতা সেন
আলপথ দিয়ে যাওয়ার সময় রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দশটার ট্রেনে দাদারা কলেজে যাচ্ছে। সঙ্গে দিদিরাও। কামরার দরজায় কেউ কমল হাসানের মতো পা ঝুলিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে। কোনও দাদা আবার দিদির সঙ্গে ট্রেনের জানলায় মুখোমুখি বসে গল্প করছে। হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে দিদি। ঠিক যেন বনলতা সেন বসে আছে ট্রেনের জানলায়। যারা বেশি হিন্দি সিনেমা দেখত তারা বলত, শর্মিলা ঠাকুর। আর দাদারা সব রাজেশ খন্না। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। তার পরই ধানখেতের মধ্যে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হারিয়ে যেত চার কামরার ট্রেন। আমরা তখন বান্ধবীকে চিরকুটে লিখতাম তুই আমার সঙ্গে ট্রেনে করে লাভপুর যাবি? লাভপুর মানে সত্যিই লাভপুর, কায়দা করে LOVE-পুর নয়। সাহসী প্রেমিকরা অনেক কেরদানি দেখাত ট্রেনকে ব্যবহার করে। চলন্ত ট্রেন থেকে ঝুপ করে ঝাঁপিয়ে একেবারে প্রেমিকার নাকের ডগায়। অথবা ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বান্ধবীকে সাইকেলের সামনের রডে চাপিয়ে, কে ফার্স্ট হয় তার কম্পিটিশন। বলা হত, ট্রেন এত আস্তে চলে, ওই লাইনে মাথা দিয়ে সুইসাইড করা অসম্ভব। ড্রাইভার দেখতে পেয়ে ট্রেন থামিয়ে, বকুনি দিয়ে, বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু পৌলমীকে বাঁচাতে পারেনি ড্রাইভার। পৌলমীর ট্রেনে কাটা পড়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। প্রেমের ট্র্যাজেডিও বুঝিয়েছিল ট্রেন।

ভূত
কয়েকটা কামরায় কোনও লাইট ছিল না। কারা উঠত রাত্তিরবেলায় ওই সব কামরায়? ছিঁচকে চোর আর ভূত। একটা ভূত নাকি মাঝেমধ্যেই মুখে ও গোটা শরীরে ব্যান্ডেজ বেঁধে বসে থাকত সিটে। কোনও মানুষ ওই ফাঁকা কামরায় উঠলেই ঘঙঘঙ করে কাশির ওষুধ চাইত। আর একটা ভূত অন্ধকারে জানলার ধারে বসে শুধু নাকি সুরে কেঁদে যেত। কখনও অন্ধকার কামরায় উঠতে গিয়ে আবার দেখা যেত, দুটো শরীর ক্রমশই ঘন হচ্ছে। তারা যে ভূত নয়, এ কথা অবশ্য বোঝা সহজ।

তারাশঙ্কর, পথের পাঁচালী
তারাশঙ্কর যখন কলকাতা থেকে তাঁর লাভপুরের বাড়ি ফিরতেন, আহমেদপুর স্টেশনে নেমে ছোট লাইনের ট্রেন ধরেই আসতেন। তারাশঙ্করের লেখা পড়ে আমরাও খুঁজে বেড়াতাম সেই সব চরিত্র। এই ট্রেনেই কি গান গায় নিতাই কবিয়াল? এর আশেপাশেই কি থাকে বনওয়ারি বা করালী? আবার, কুঞ্জপুকুরের পাড় ধরে চলে যাওয়া ছোট্ট ট্রেনটার পুরোটাই পুকুরের জলে প্রতিবিম্বে দেখতে পেতাম। এক দিকে মাটির ওপর ট্রেন চলছে, অন্য দিকে জলের মধ্যে দিয়ে। ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় পড়ন্ত আলোয় এই ম্যাজিক আমরা দেখতাম ক্রিকেট খেলা থামিয়ে। ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়ে, ও মা, একই ম্যাজিক, শুধু ট্রেন নয়, মিষ্টিওয়ালার পিছন পিছন ছোট ছেলেমেয়ে আর কুকুর।

যখন শেষ
কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চলত ডিজেল চালিত ট্রেন। সেই ট্রেনটাও সম্প্রতি হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো। এই বছরের ১৩ জানুয়ারি থেকে বাতিল হয়ে গেল। এই ট্রেনের পোশাকি নাম ছিল আহমেদপুর কাটোয়া ন্যারোগেজ ট্রেন। ৫২ কিলোমিটারের এই রেলপথ ব্রিটিশ আমলে ১৯১৭ সালে চালু হয়েছিল। লন্ডনের ম্যাকলিয়ড রাসেল্স অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড এই দেশে চারটি ন্যারোগেজ লাইন তৈরি করেছিল। বর্ধমান কাটোয়া রেলওয়ে, বাঁকুড়া দামোদর রেলওয়ে, কালিঘাট ফলতা রেলওয়ে এবং আহমেদপুর কাটোয়া রেলওয়ে। ১৯৬৬ সালে ভারতীয় রেল এই আহমেদপুর কাটোয়া লাইনের দায়িত্ব নেয়। তার পর থেকে চারটি ট্রেন এই লাইন ধরে যাতায়াত করত। স্টেশনে টিকিট কাউন্টার ছিল ঠিকই, কিন্তু তার সামনে কখনও লাইন পড়তে দেখিনি। রেল বাজেটে ট্রেনের ভাড়া বাড়ল না কমল সে নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না।
গরুর গাড়ি আর ছোট লাইনের ট্রেন বীরভূমের লাল মাটির গ্রামের পথে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে ৯৬ বছর। আমরা কোনও দিনই চাইনি এই লাইন মিশে যাক বড় লাইনের সঙ্গে। সব ছোটকে যে বড় হতেই হবে সেই দিব্যি কে দিয়েছে? তবু ব্রডগেজ হবে, তাই এই ছোট লাইন ধরে ট্রেন যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঘণ্টায় পনেরো কিলোমিটার গতিবেগও এবার থেমে গেল। বড় ট্রেন ঢুকবে এই গঞ্জ শহরগুলোতে। উন্নয়নের ডাক। এই লাইন ধরেই গ্রামের লোকেরা সোজা পৌঁছে যেতে পারবে কলকাতায়। গঞ্জ শহরও তার চরিত্র পাল্টেছে। ভিডিয়ো হলগুলো উঠে গিয়েছে। সেই সাইকেল চালক আর আসে না। কেব্ল টিভির ডিশ অ্যান্টেনা বসেছে, বাড়ির ছাদে বসেছে মোবাইল টাওয়ার। তবু পালটে যাওয়া এই গঞ্জে কোনও মতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মানিয়ে গিয়েছিল এই ট্রেন। খুব ক্লান্ত, তবু নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে সারা দিনে দু’বার অন্তত যেত। গ্রামের রাস্তার ছোট ছোট লেভেল ক্রসিংয়ে হুইস্ল বাজিয়ে বলত, আমি আছি। আমি এখনও আছি।

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.