শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান
আজকের হিরো: দ্য হোয়াই চিপ আর্ট
কে বলে, বহুমূল্য চিত্রকলা, স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যই একমাত্র শিল্প? প্রায় তিরিশ বছর আগে আমেরিকার এক পুতুলনাচ কোম্পানির ম্যানিফেস্টো বদলে দিয়েছিল শিল্প সম্বন্ধে আমাদের ধ্যানধারণা।
পিকাসো, গণেশ পাইনের ছবি ক’জন আর কিনতে পারেন? কিন্তু আজ যে অনেকেই ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে পরিবারের শিশুটির প্যাস্টেলে-আঁকা ছবি ফ্রেমবন্দি করে রাখেন, নিদেনপক্ষে মিকি মাউস বা হিচককের পুরনো ছবির পোস্টার সুদৃশ্য ভাবে বাঁধিয়ে রেখে দেন, গ্যালারির বার্ষিক এগজিবিশনে যোগেন চৌধুরীর আঁকা কাপ বা কোস্টার কিনে নিয়ে যান, সে সবের পিছনেও সেই মার্কিন পুতুলনাচের ইতিকথা: দ্য হোয়াই চিপ আর্ট?
১৯৮৪ সালে আমেরিকার ‘ব্রেড অ্যান্ড পাপেট থিয়েটার’-এর ম্যানিফেস্টোটি শিরোনাম থেকেই চোখ টানে। হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা গোছের বিবৃতি নয়। বরং জিজ্ঞাসাচিহ্নের সূচকে একটি প্রশ্নবাক্য। প্রশ্নবাক্যের জন্যই একে খাটো করে ‘সস্তা শিল্প’ বা ‘চিপ আর্ট ম্যানিফেস্টো’ বলা সম্ভব নয়। ‘হোয়াই’ শব্দটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। হোয়াই শব্দটিকে বিশেষ ভাবে নির্দেশ করার জন্যই তো যাবতীয় ব্যাকরণ তুচ্ছ করে তার আগে ‘দ্য’ শব্দটি বসানো।
পুতুলনাচের দলটি ষাটের দশকে নিউ ইয়র্কে শুরু হয়। ছোটদের আকর্ষণ করার জন্য বড়দিন, ইস্টার, থ্যাংক্সগিভিং ডে-তে রাস্তায় পুতুলনাচের হরেক অনুষ্ঠান করত তারা। পাশাপাশি পুতুলনাচে বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাওয়া, পুলিশি অকর্মণ্যতা, এলাকায় আবর্জনা ও ইঁদুর বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি হরেক ঘটনা বলা হত। বড়রা ভিড় জমিয়ে সেই সব দেখত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এই ‘ব্রেড অ্যান্ড পাপেট থিয়েটার’ই পুতুলনাচ দেখিয়ে শ’য়ে শ’য়ে তরুণদের নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ জানাত।
আটের দশকের শুরুতে এই সংস্থার পরিচালক পিটার শুমান ও তাঁর বন্ধুরা একটি বিশেষ ঘটনা ঘটালেন। পুরনো এক স্কুলবাসের গায়ে লাগানো হল ম্যাসোনাইট বোর্ড, কার্ডবোর্ডে সাঁটা ছোট ছোট ছবি। রঙিন ছবি-আঁটা বাস এর পর দিনকয়েক ভারমন্ট শহরের এই মহল্লা থেকে সেই মহল্লায় যাতায়াত শুরু করল, রাস্তার লোকজন কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিছনের জানলায় লাগানো অমুক ছবিটা কেনা যায়?’ উত্তর পাওয়া গেল, অবশ্যই! ১০ সেন্ট থেকে ১০ ডলারের মধ্যে রাখা হয়েছে সব দাম। দেখতে দেখতে সব ছবিই বিক্রি হয়ে গেল।
এর কয়েক মাস পরেই বেরোল ‘দ্য হোয়াই চিপ আর্ট?’ ম্যানিফেস্টো। মাত্র এক পৃষ্ঠার ম্যানিফেস্টো, টাইপোগ্রাফিতেই বড় হাতের, ছোট হাতের অক্ষর মিলিয়ে যাবতীয় কারিকুরি। বড় হাতের অক্ষরে লেখা হল, ART IS NOT BUSINESS! পরের লাইনে ছোট হাতে, It does not belong to banks and fancy investors। কোথাও কোথাও মোটা অক্ষরের বোল্ড টাইপ। সবচেয়ে বোল্ড টাইপ শেষ লাইনে। ‘আর্ট ইজ চিপ’ লিখে শেষে ঢাউস চেহারার ধ্বন্যাত্মক আনন্দ-উচ্চারণ: HURRAH! পৃথিবীতে এর আগে ও পরে শিল্পের নানা ম্যানিফেস্টো লেখা হয়েছে, কিন্তু মাত্র এক পৃষ্ঠায় টাইপোগ্রাফির বিভিন্নতা নিয়ে আর্ট-ম্যানিফেস্টো এই প্রথম।
মাত্র এক পৃষ্ঠার অবসরে ছোট-বড় টাইপের এই কোলাজ একটি জিনিস তৈরি করল। ভিস্যুয়াল মেজাজ! ম্যানিফেস্টোটিকেই সরু ফ্রেমে বাঁধিয়ে বসার ঘরে ফ্রিজের গায়ে বা টবের গাছের আড়ালে রেখে দিন, চমৎকার লাগবে। টাইপোগ্রাফির এই ভিন্নতা আজ ছোটদের পড়ার ঘরে সাঁটা বিভিন্ন পোস্টারেও!এখানেই ম্যানিফেস্টোর বৈশিষ্ট্য। একদা আপোলেনিয়রের মতো কবি, আঁদ্রে বারোজ, লুই ফার্দিনান্দ সেলিন তাঁদের উপন্যাসে ছাপার হরফ নিয়ে হরেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু ছাপা বইয়ের চৌকাঠের বাইরে সে বারেই প্রথম বেরিয়ে এল টাইপোগ্রাফির পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ম্যানিফেস্টো আরও নানা কথা বলল, ‘শিল্প হবে সস্তা, সকলের নাগালের মধ্যে। শিল্প ব্যথার উপশম ঘটায়, ঘুমন্তকে জাগিয়ে তোলে, যুদ্ধ এবং নির্বুদ্ধিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।’
কী ভাবে শিল্পকে পৌঁছে দেওয়া যায় সকলের নাগালের মধ্যে? আটের দশকে জেরক্স, ডিজিটাল প্রিন্টিং অনেক কিছুই পৃথিবীতে এসে গিয়েছে। ইজেল এবং ক্যানভাসের বাইরে বেরিয়েও গ্রিটিংস কার্ড, পোস্টারে নানা ভাবে ছবির রিপ্রোডাকশন সম্ভব। প্রযুক্তিই এনে দিল শিল্পচেতনায় বিপ্লব। ‘লোকে অনেক দিন ধরে ভাবছে, শিল্পকলা শুধু মিউজিয়াম এবং বড়লোকদের বিশেষ অধিকার,’ স্পর্ধিত উচ্চারণ সে দিনের ম্যানিফেস্টোয়।
তামাম দুনিয়ায় সেই বিশেষ অধিকারের দিন শেষ। নিতান্ত মধ্যবিত্তও আজ অন্দরসজ্জার জন্য ব্যবহার করতে পারেন কমদামি ছবি, মাস-প্রোডাকশনে তৈরি ডোকরার অ্যাশট্রে, টেরাকোটার হাতি বা ছৌ নাচের মুখোশ। শেষোক্ত তিনটি কমদামি লোকশিল্প, সম্ভ্রান্ত শিল্প বা ‘হাই আর্ট’-এর দুনিয়া থেকে অনেক দূরে। দরকার নেই ওই হাই আর্ট! বরণ করে নেব নিচুতলার শিল্পকলাকে। আটের দশকেই ‘ব্রেড অ্যান্ড পাপেট থিয়েটার্স’-এর পিটার শুমান শিল্পকলা বিষয়ক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমরা পুতুলনাচ, মুখোশ উৎপাদন করি। আমরা নিচুতলার শিল্প তৈরি করি, সেটিই চাই। ওই সব ফাইন আর্টস বা সূক্ষ্ম শিল্প নয়। মোটা দাগের শিল্প বা কোর্স আর্টই আমরা ব্যবহার করি।’ কথাটার মধ্যে একটা অভিমানী ঝাঁজ আছে, যে অভিমান সঙ্গত।
ইউরোপে প্রদর্শনীর পরেও এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ এক সময় তাঁর আঁকা ছবি পরিচিতদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়েছেন। যামিনী রায় লোকশিল্পের আঙ্গিকে ছবি এঁকে কম দামে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ষাটের দশকেও বাঙালি তরুণ শিল্পীরা মুক্তমেলায় কম দামে ছবি বিক্রি করেছেন। সারা পৃথিবী জুড়েই শিল্পীরা গ্যালারি এবং উচ্চবিত্তের ড্রয়িং রুমের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছতে চাইছিলেন আরও বেশি মানুষের কাছে। আটের দশকে এই ম্যানিফেস্টো দীর্ঘ দিনের সেই ইচ্ছাকেই ভাষায় প্রকাশ করল।
বিপ্লব, আজও! নিউ ইয়র্কের ‘মোমা’-র মতো বিশ্বখ্যাত অনেক মিউজিয়ামেই পাওয়া যায় চমৎকার প্রিন্ট। কলকাতা শহরেও অনেক আর্ট গ্যালারি বছরে এক-দু’বার কম দামে খ্যাতনামা শিল্পীদের ‘এগজিবিশন কাম সেল’ আয়োজন করে, সকাল থেকে লাইন পড়ে যায়। বইমেলার সময় মমার্তে লোকের ভিড়, কেউ কিনছেন এক দানা চালের ওপর লেখা ছড়া, কেউ বা আঁকিয়ে নিচ্ছেন চটজলদি নিজের পোর্ট্রেট। তিরিশ বছর আগেই তো ম্যানিফেস্টো বলেছিল, শিল্প শুধু মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারির সম্পদ নয়। কে জানত, পুতুলনাচও বদলে দেয় শিল্পের ভবিষ্যগাথা!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.