দোলনা চড়া হয়ে গিয়েছে। স্লিপেও চড়েছি। স্লিপে উঠে দ্বিতীয় বার নামতে গিয়ে স্কার্টে কাদা লেগে গিয়েছে। এখন বর্ষাকাল। জামাকাপড়ে কাদা লাগলে আমার অবশ্য ভালই লাগে, কিন্তু মা রেগে যায়। রেগে মা মারে না, ‘হোম টাস্ক শাস্তি’ দেয়। আগে পাঁচটা অঙ্ক করতে হলে জামায় কাদা মাখানোর জন্য ডবল করতে হবে। আর রিস্ক না নিয়ে আমি এখন পার্কের বেঞ্চে বসে আছি। অচেনা দাদুও এসে গিয়েছে।
রোজই আসে। আমাদের হাউজিংয়ে থাকে না বলে দাদুর নাম হয়ে গিয়েছে অচেনাদাদু। দাদুর প্রচুর গল্পের স্টক। অচেনাদাদুর কাছ থেকে গল্প শুনি আমরা।
দেখা হতেই অচেনাদাদু মুচকি হাসল। বল্টু ছুটে এসে বলল, আজ ভূতের গল্প, আজ...।
আমি বললাম, না। আজ মৎস্যকন্যার গল্প। সেই যে একটা মেয়ে, কিন্তু পায়ের বদলে রুপোলি আঁশের কারুকাজ করা লেজ। সমুদ্রে সমুদ্রে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায়, মাছেদের কথা বুঝতে পারে, হাঁটু অবধি সিল্কি চুল, মাথায় রঙিন রঙিন পাথরের মুকুট পরে।
হাল্কা হাওয়ায় অচেনাদাদুর সাদা পাতলা চুল অল্প উড়ছে। পার্কে এখন অর্ধেক লোক। বেশ চুপচাপ। গল্প শোনার পক্ষে ভাল। দাদু বলল, আজ একটা ভূতের গল্প বলি বরং, যার মধ্যে রূপকথাও মিশে আছে।
আমি বললাম, দারুণ।
তবে শুরু করা যাক টিয়া? বলে অচেনাদাদু হাসল।
আমার ‘হ্যাঁ’ বলার আগেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল বল্টু, হে হে টিয়াপাখি! |
আমি প্রতিবাদ করলাম, মোটেই আমি পাখিটাখি না। আমার স্কুলে নাম অপাবৃতা দাশগুপ্ত। ক্লাস সেভেন, সেকশন এ। রোল নম্বরটাও বল্টুকে শুনিয়ে দেব ভাবছিলাম, কিন্তু অচেনাদাদু থামিয়ে দিল।
গলায় আদরের সুর এনে অচেনাদাদু বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে। তোমরা দু’জন হলে রাজকন্যা আর রাজপুত্র। এ বার গল্পটা বলি শোনো এটা মেঘেদের দেশের পার্কের গল্প। আকাশে সেই ঝুলন্ত পার্ক। সেখানেও এই পার্কের মতো দোলনা, স্লিপ, সবুজ ঘাস, ফুল আছে। প্রজাপতি ওড়ে। সেখানেও বিকেল হলেই ছেলেমেয়েরা খেলতে আসে।
আমি বললাম, পার্কটা যখন আকাশে, তখন সবার ডানা থাকবেই, না হলে ফ্লাই করবে কী করে! তাই না?
অচেনাদাদু বলল, একদম ঠিক।
বল্টু বলল, তার পর।
বল্টুরাজা, টিয়ারানির মতো দু’জন ছেলেমেয়ে সেখানে এক দিন সাদাদাদুকে পেল।
আমি বললাম, সাদাদাদু? সাদা কেন?
সেই দাদুর মাথার চুল, দাড়ি, গোঁফ সব তো বরফের মতো সাদা ধবধবে। তার মধ্যে আবার সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। বলল অচেনাদাদু।
বল্টু বলল, হে হে এ তো আমাদের গল্প।
আমি বললাম, সবজান্তা। তুই থাম তো।
অচেনাদাদু আবার শুরু করল, রোজ বিকেলে তোমাদের মতো দু’জন নাতি-নাতনিকে মেঘপার্কের উড়ন্ত বেঞ্চে বসে গল্প শোনাত। সেই সাদাদাদুর আর কেউ ছিল না। কোনও কথা বলার মানুষ, বিষয়, কিচ্ছু ছিল না। তো গল্প শোনানোর মতো দু’জন নাতি-নাতনিকে পেয়ে দারুণ দিন কাটছিল সাদাদাদুর। আনন্দে তার বুড়ো ডানা দুটো ছোটদের মতো হাততালি দিয়ে উঠত মাঝে মাঝে। এই ভাবেই ভালয় ভালয় সব চলছিল। কিন্তু গোলমাল হল।
বল্টু আর আমি বললাম, গোলমাল কেন?
এক দিন রোজকার মতোই বিকেল হল। পার্কে সবই রয়েছে দোলনা, স্লিপ, ফুল, প্রজাপতি, ছেলেমেয়েরা। শুধু সাদাদাদু এল না। দ্বিতীয় দিনও গেল। কিন্তু সাদাদাদুর দেখা নেই। টিয়ারানি আর বল্টুরাজার মতো দু’জন কিছুই বুঝতে পারে না! সাদাদাদু আসছে না কেন! অথচ গল্প শুনতে রোজ খেলা সেরে ওরা নির্দিষ্ট বেঞ্চে এসে বসে থাকে!
বল্টু বলল, আমরা!
অচেনাদাদু বলল, হ্যাঁ। আবার না।
আমি বললাম, তার পর?
‘টিয়া। অ্যাই টিয়া।’ মা’র গলা। দেখলাম মা পার্কের গেট খুলে ঢুকছে। এমা সন্ধে হয়ে গিয়েছে! পার্ক তো ফাঁকা! খেয়ালই করিনি। হ্যালোজেনের হলদেটে আলোয় ঘাস, গাছ-পাতা সব হলুদ হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, আজ ক’টা অঙ্ক শাস্তি পাব, কে জানে!
বল্টু বলল, দাদু কোথায়? অচেনাদাদু?
আমার বল্টুর কথায় মন নেই। মাকে দেখছি। মা হন হন করে হেঁটে এল আমাদের বেঞ্চ অবধি। বলল, ‘এই ভর সন্ধেবেলা এখানে ভূতের মতো বসে আছিস। ভয়ডর নেই তোদের?’
বললাম, ভয় পাব কেন, এই তো সাদাদাদু।
‘কে?’
সরি। মানে অচেনাদাদু। আমাদের গল্প বলছিল তো। সে জন্যই তো...।
বল্টু চোখ বড় করে বলল, দাদু কোথায় গেল?
মা অবাক হয়ে বলল, ‘সেটা আবার কে? বাড়ি চলো। কাল থেকে তোমাদের পার্কে আসা বন্ধ।’
ভাবছিলাম ব্যাপারটা কী হল। অচেনাদাদু কোথায় গেল। দাদুকে মা দেখতে পেল না কেন! অচেনাদাদু কি নিজেই...! কী করে হয়, এই তো আমাদের পাশেই বসেছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল! ভেতরে ভেতরে গা কেঁপে উঠল আমার। মা’র বকাবকির জন্য ভয়টা বাড়তে
পারছে না। না হলে হয়তো অজ্ঞান বা ও রকম কিছু হয়ে যেতাম।
হঠাৎ, ওই তো টিয়া, ওই তো সাদাদাদু কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল বল্টু।
মা আমাদের দু’জনের দু’হাত ধরে পার্কের বাইরে রাস্তার দিকে বকতে বকতে নিয়ে যাচ্ছে। বল্টুর কথায় আমি পিছন ফিরে তাকালাম।
হ্যাঁ! অচেনাদাদুই তো! মানে সাদাদাদু। ঘোলাটে আলোর নির্জন ভুতুড়ে পার্কে একা একা পায়চারি করছে। হাঁটছে না উড়ছে বোঝা যাচ্ছে না! পিঠে ডানাও আছে, ডানা দুটোর রংও সাদা। |